মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮

ভাবসম্প্রসারণ


(১) প্রয়োজন ব্যতিত বন্ধু ও শত্রু চেনা যায় না।

মানুষ সামাজিক প্রাণী বলে একাকি বাস করতে পারে না। তাকে সমাজে বাস করতে হয়। জন্মের পর থেকেই মানুষ অসহায়। সংগ্রাম করে তাকে জীবনযাপন করতে হয়। জীবন সংগ্রামের পথে মানুষকে সমাজের মানুষের সাথে মিশতে হয়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কারো কারো সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠে। যারা প্রকৃত বন্ধু, শুভাকাঙ্খী তারা মানুষের ভালো চায়, কল্যাণ কামনা করে। আর যারা শত্রু তারা অপরের অমঙ্গল কামনা করে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। মানুষের জীবনে সুসময় এবং দুঃসময় পর্যায়ক্রমে আসে। সুসময়ে বন্ধু এবং শত্রু কাউকে চেনা যায় না। সবাই তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বন্ধুত্বের বুলি শুনায়। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, যখন প্রয়োজন হয়, তখন বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃত বন্ধুরা বিপদের সময় কখনও ছেড়ে যায় না। যারা বিপদের মুখে বন্ধুকে রেখে পালিয়ে যায় তারা বন্ধুরূপী শত্রু। তারা বসন্তের কোকিলের মতো জীবনে আসে। তারা আসে শুধু তাদের প্রয়োজনেই। তারা আসলেই স্বার্থপর। এসব স্বার্থপর লোক বন্ধু হতে পারে না। স্বার্থপর বন্ধু ও শত্রু দুর্দিনে বা সংকটকালে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে না, বরং বিপদে ফেলে চলে যায়। একমাত্র প্রয়োজনের সময়ই বন্ধু ও শত্রু আলাদাভাবে নিরূপন করা যায়। প্রয়োজনই বন্ধু ও শত্রু চেনার পরিমাপক।

শিক্ষা: বন্ধু নির্বাচন করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধু জীবনে চলার পথে অপরিহার্য অঙ্গ। অপ্রকৃত বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে হবে।

(২) অসির চেয়ে মসি বড়।

‘অসি’ অর্থাৎ তরবারি ক্ষমতার প্রতীক। আর ‘মসি’ অর্থাৎ লেখার জন্য ব্যবহৃত কালি জ্ঞানের প্রতীক। ক্ষমতালিপ্সু মানুষরা অসির বলে অনেক প্রাণ বিনষ্ট করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু অল্পদিনই তারা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সেই স্থান দখল করে নেয় অন্য কোনো ক্ষমতাপিপাসু মানুষ। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। পক্ষান্তরে মনীষীগণ মসির সাহায্যে মানবজাতির কল্যাণে অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম লিপিবদ্ধ করে যান। যা যুগে যুগে মানুষকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। তাঁদের লিপিবদ্ধ চিন্তাধারা সভ্যতাকে নিয়ে যায় উৎকর্ষের পথে। আর এই উৎকর্ষের পথ ধরেই মনীষীগণ সম্মান পান মানুষের অন্তরে। অন্য কেউ তাঁদের সম্মানটি দখল করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁরা অমলিন হয়ে থাকেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। কিন্তু যারা অসির বলে বলীয়ান মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। অসি আর মসির মধ্যে যুদ্ধে মসি হেরে যাবে। কিন্তু অসির এ জয় ক্ষণিকের। শাশ্বত ন্যায় যুদ্ধে মসিই বিজয়ী। অসির ক্ষমতা ধূমকেতুর ন্যায়। এর স্থায়িত্ব খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু মসির ক্ষমতা সূর্যের ন্যায়। সূর্য যেমন সৃষ্টির আদি থেকে প্রতিদিন তার নিয়মেই আলো ছড়াচ্ছে, মসিও তেমনি অনন্তকাল ধরে নীরবে মানুষকে সত্য, সুন্দর ও শান্তির পথ দেখাচ্ছে।

শিক্ষা: অসি তার ধ্বংসলীলার মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে দুঃখের সাগরে ভাসায়। আর মসি তার ফোঁটায় ফোঁটায় গড়ে তোলে স্বপ্ন, সভ্যতাকে নিয়ে যায় সমৃদ্ধির পথে। তাই মসিই হওয়া উচিত আমাদের জীবনে চলার পথের পাথেয়।

(৩) আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। আত্মশক্তি অর্থাৎ মানুষের নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়ানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আত্মশক্তি মানুষের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে না। শিক্ষা সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। জগতে নিজের অবস্থানকে মজবুত করে ধরে রাখতে শিক্ষার প্রয়োজন। তাই শিক্ষাকে সারা বিশ্বে একটা নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। কারণ জ্ঞানীগুণীরা জানেন শিক্ষা গ্রহণ না করে কেউ সফল হতে পারে না। আর যারা অশিক্ষিত, শিক্ষা গ্রহণ করে না তারা নিজেদের শক্তিকে বিকশিত করতে পারে না। তবে শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষা মানুষকে সফল করতে পারে না। এমন শিক্ষা অর্জন করতে হবে যা মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়িয়ে তোলে এবং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। আত্মশক্তি মানুষকে স্বনির্ভর হতে শেখায়, মানুষকে যোগ্য করে গড়ে তোলে এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করে। আত্মশক্তি আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিরূপ। তাই প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে পারে এমন শিক্ষা অর্জন করতে হবে। জীবনে সফল হতে হলে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। নিজের যোগ্যতা না থাকলে কেউ এতসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে না। আর এই যোগ্যতা অর্জিত হয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের পথ দেখায় শিক্ষা। তবে যে শিক্ষা আত্মবিশ্বাসকে বাড়াতে পারে না সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়। কারণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে বাড়ানো। আত্মশক্তি না থাকলে মানুষ পরনির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। যা কারো কাছেই পছন্দনীয় নয়। তাই শিক্ষা গ্রহণ করে আত্মনির্ভর হয়ে নিজেকে দেশ ও সমাজের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

শিক্ষা: জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে চাইলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আত্মশক্তি অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা বা সামর্থ্য বৃদ্ধি করে শুধু নিজের জন্য নয় সমাজের জন্যও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।



(৪) দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।

শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। কিন্তু কোনো মানুষ যদি আচরণগত বা চরিত্রগতভাবে খারাপ হয় তবে সে শিক্ষিত হলেও সমাজের বা মানুষের উপকার করে না বরং ক্ষতি করে। যেহেতু শিক্ষা গ্রহণের অধিকার সবার আছে তাই খারাপ লোকেরা চাইলেই শিক্ষিত হতে পারে। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করেও তারা প্রকৃতপক্ষে গুণী বা ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। দুর্জন তার অর্জিত বিদ্যাকে ভালো কাজে ব্যবহার না করে খারাপ কাজে ব্যবহার করে। দুর্জন ব্যক্তি যেকোনো ধরণের খারাপ কাজ করতে দ্বিধা করে না। বিদ্বানকে সবাই সমাদর করে কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তি যদি মানুষ হিসেবে ভালো না হয়, তবে তার সান্নিধ্য কেউ কামনা করে না। বিদ্বান হয়েও যে বিদ্যার মূল্য দিতে পারে না, সে সবদিক থেকে নিকৃষ্ট। তার কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো। দুর্জন বিদ্বান হলেও তার ভেতরের কু-প্রবৃত্তিগুলো তাকে খারাপ কাজের প্ররোচনা যোগায়। চারিত্রিক গুণাবলি বিদ্যার চেয়েও দামী। তাই প্রকৃত অর্থে দুর্জন বিদ্বানের চেয়ে চরিত্রবান অশিক্ষিত ব্যক্তি অনেক ভালো। সব বিষয়েরই দুটো দিক থাকে একটা ভালো অপরটি মন্দ। তেমনি বিদ্যার মাধ্যমে মানুষ সুশিক্ষা যেমন গ্রহণ করতে পারে আবার কুশিক্ষাও গ্রহণ করতে পারে। দুর্জন শিক্ষিত হয়ে তার বিদ্যাকে আরও সহজে খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে। দুর্জনেরা বিদ্যাকে অসৎ উদ্দেশ্যের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করে। দুর্জনের সাথে থেকে ভালো মানুষও খারাপ হয়ে যেতে পারে বলে দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাজ্য। প্রবাদ আছে- “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” এক ঝুড়ি আমে একটি পঁচা আম থাকলে একসময় সব আমই পঁচে পায়। তেমনি সমাজে একজন অসৎ ব্যক্তির দ্বারা অনেক ভালো মানুষ প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাদেরকে পরিত্যাগ করেই চলতে হয়।

শিক্ষা: কোনো ব্যক্তি যত শিক্ষিত বা জ্ঞানীই হোক না কেন, যদি ব্যক্তিগতভাবে অথবা চারিত্রিক দিক থেকে ভালো মানুষ না হয় তবে তার কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।