কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কবিতা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৯

কবিতা



John Doe
আলী হাসান শিমুল প্রকাশ ১২ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯ইং:-


শরতের স্লান বিল --- এডিথ স্যোডেরগ্রান :

শরতের স্লান বিল
কী ভারী স্বপ্ন দ্যাখো তুমি বারে-বারে
বসন্ত-সাদা দ্বীপ
ডুবেছে যা পারাবারে।

শরতের স্লান বিল,
লুকায় তোমার বীচি,
তোমার আয়না ভুলে যায় যত
শুভদিন হারিয়েছি।

শরতের স্লান বিল
উচু আকাশেরে হাল্কা, নীরব বহে,
ক্ষণেকের তরে জীবন-মরণ
ঘুম-ঘুম চোখে চুম্বন করে দোঁহে।
(Pale Lake of Autumn)

তুমি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশে মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছো অসীম।

বেদনা-মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনো ভাবি অপার্থিবা কিনা।

সারারাত পৃথিবীতে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে, স্থির জানি, তুমি দেবে ক্ষমা

তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।


কালো বা সাদা----- এডিথ স্যোডেরগ্রান

সেতুদের নীচে নদীগুলি ব’য়ে যায়,
পথপাশে ফুল করে সব রোশনাই,
মাঠেদের কানে, ফিসফিস করে নু’য়ে-নু’য়ে পড়ে বন।
আমার জন্য উচুনিচু কিছু নাই,
অথবা কালো বা সাদা,
সেইদিন থেকে, যখন ধবল পোশাকের এক নারী
দেখেছি আমার প্রিয়ের বাহুতে বাঁধা।
(Black or White)

তারার ঝাঁক----- এডিথ স্যোডেরগ্রান

রাত্রি এলে
আমি দাঁড়াই সিঁড়িতে আর শুনি
অযুত তারার গুনগুনুনি আমার বাগানটিতে
এবং আমি আঁধারে দাঁড়ানো।
ঐ খশল একটা তারা ঠুং ক’রে!
খালি-পায়ে হাঁটিস না রে ঘাসে;
বাগান ভ’রে আছে ভাঙা-কাচে।
(The Stars)

বিজ্ঞাপন অথবা ছবি
পাখির মেলা
Cinque Terre Cinque Terre Cinque Terre

তোমার চোখ এতো লাল কেন? – নির্মলেন্দু গুণ


আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।

আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’

শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

কবিতা 12


কবিতা

Girl in a jacket



কবিতা
ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়
যাইতে যাইতে খ্যাঁচখ্যাচায়
প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ
কাওয়ারা সব লইল পাছ
প্যাঁচার ভাইস্ত কোলাব্যাঙ
কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং
প্যাঁচায় কয় বাপ, বাড়িতে যাও
পাছ লইছে সব হাপের ছাও
ইঁদুর জবাই কইর্যাপ খায়
বোঁচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়।
(প্যাঁচা,কাজী নজরুল ইসলাম)



রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৮

কবিতা বিশ্ব সাহিত্য


বিশ্ব সাহিত্য

The Road Not Taken
--- Poem by Robert Frost

Autoplay next video
Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth;

Then took the other, as just as fair,
And having perhaps the better claim
Because it was grassy and wanted wear,
Though as for that the passing there
Had worn them really about the same,
And both that morning equally lay
In leaves no step had trodden black.
Oh, I kept the first for another day!
Yet knowing how way leads on to way
I doubted if I should ever come back.

I shall be telling this with a sigh
Somewhere ages and ages hence:
Two roads diverged in a wood, and I,
I took the one less traveled by,
And that has made all the difference.


রবার্ট ফরেস্ট এর কবিতা ও ভিডিও


শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১৮

কবিতা


Bootstrap Example

জীবনান্দ দাসের কবিতা

ধূসর পান্ডুলিপি


এই সব দিনরাত্রি
মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
শরীর বিবশ হ’লে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের
কংগ্রেসের মতো কোনো অাশা হতাশার
কোলাহল নেই।
অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।
আরো ঢের লোক অাছে
সঠিক শ্রমিক নয় তা’রা।
স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝ’রে
এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।
নামগুলো কুশ্রী নয়, পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এই সব।
আমরা অনেক দিন এ-সব নামের সাথে পরিচিত; তবু,
গৃহ নীড় নির্দেশ সকলি হারায়ে ফেলে ওরা
জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের
মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে;
জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে;
অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে।
মেডিকেল ক্যাম্বেলের বেলগাছিয়ার
যাদবপুরের বেড কাঁচড়াপাড়ার বেড সব মিলে কতগুলো সব?
ওরা নয়— সহসা ওদের হ’য়ে আমি




ধূসর পান্ডুলিপি

কার্তিক মাঠের চাঁদ(মাঠের গল্প)
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ —
পাহাড়ের মতো অই মেঘ
সঙ্গে লয়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতে আকাশে
যখন তোমারে! —
মৃত কে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে!
ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চলে
তরাসে ছেলের মতো– আকাশে নক্ষত্র
গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়–
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে– চাঁদ–
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা– তারপর হাতছাড়া হয়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে– আজও তুমি তার স্বাদ লয়ে
আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছ এসে!
নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে,
শস্যের ক্ষেত চেষে চেষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প– তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে
অনেক তবুও থাকে বাকি–
তুমি জানো– এ পৃথিবীর আজ জানে তা কি!






Bootstrap Example

জীবনান্দ দাসের কবিতা

ধূসর পান্ডুলিপি


এই সব দিনরাত্রি
মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।
এইখানে
পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
শরীর বিবশ হ’লে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের
কংগ্রেসের মতো কোনো অাশা হতাশার
কোলাহল নেই।
অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।
আরো ঢের লোক অাছে
সঠিক শ্রমিক নয় তা’রা।
স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝ’রে
এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।
নামগুলো কুশ্রী নয়, পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এই সব।
আমরা অনেক দিন এ-সব নামের সাথে পরিচিত; তবু,
গৃহ নীড় নির্দেশ সকলি হারায়ে ফেলে ওরা
জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের
মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে;
জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে;
অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে।
মেডিকেল ক্যাম্বেলের বেলগাছিয়ার
যাদবপুরের বেড কাঁচড়াপাড়ার বেড সব মিলে কতগুলো সব?
ওরা নয়— সহসা ওদের হ’য়ে আমি




ধূসর পান্ডুলিপি

কার্তিক মাঠের চাঁদ(মাঠের গল্প)
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ —
পাহাড়ের মতো অই মেঘ
সঙ্গে লয়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতে আকাশে
যখন তোমারে! —
মৃত কে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে!
ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চলে
তরাসে ছেলের মতো– আকাশে নক্ষত্র
গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়–
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে– চাঁদ–
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা– তারপর হাতছাড়া হয়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে– আজও তুমি তার স্বাদ লয়ে
আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছ এসে!
নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে,
শস্যের ক্ষেত চেষে চেষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প– তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে
অনেক তবুও থাকে বাকি–
তুমি জানো– এ পৃথিবীর আজ জানে তা কি!






বুধবার, ২০ জুন, ২০১৮

কবিতা


খতিয়ান

– রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ

হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় ঋণে
অথচ আমার শস্যের মাঠ ভরা।
রোদ্দুর খুঁজে পাই না কখনো দিনে,
আলোতে ভাসায় রাতের বসুন্ধরা।
টোকা দিলে ঝরে পচা আঙুলের ঘাম,
ধস্ত তখন মগজের মাস্তুল
নাবিকেরা ভোলে নিজেদের ডাক নাম
চোখ জুড়ে ফোটে রক্তজবার ফুল।
ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে,
উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা
পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে
আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা–
টোকা দিলে ঝরে পড়বে পুরনো ধুলো
চোখের কোণায় জমা একফোঁটা জল।
কার্পাস ফেটে বাতাসে ভাসবে তুলো
থাকবে না শুধু নিবেদিত তরুতল
জাগবে না বনভূমির সিথানে চাঁদ
বালির শরীরে সফেদ ফেনার ছোঁয়া
পড়বে না মনে অমীমাংসিত ফাঁদ
অবিকল রবে রয়েছে যেমন শোয়া
হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে
অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি
ছুটে যেতে চাই– পথ যায় পায়ে থেমে
ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি


一一一一一一一
মহাপৃথিবী গ্রন্থ
mozahid
10/7/2018,thuesday

শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮

কবিতা


আমি কিংবদন্তির কথা বলছি--আবু জাফর ওবায়দুল্লা


আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো ?



সোমবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৮

কবিতা


কে

– ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত

বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,
সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,
পরের যে ভাল করে, সাধু বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,
নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে।
ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি

সোমবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৮

কবিতা

গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা 
    রাজু  আলাউদ্দিন অনুদিত


বাতায়নের সামনে সাদা তুষার ঝরে পরে ,   

উচ্চরোলে সান্ধ্যকালীন ঘণ্টা বেজে ওঠে ,
অনেকেরই জন্য টেবিল সাজিয়ে রাখা আছে,
ঘরের মধ্যে অথৈ আয়োজন।

তমসাময় পথের মাথায়  এসে
প্রবেশ করে অনেক পান্থজন
এই পৃথিবীর শীতল রস থেকে
দয়াাময়ী বৃক্ষ ফোটায় সোনালী সম্ভার।

শান্ত পায়ে পান্থ প্রবেশ করে;
প্রবেশ-পথ তীব্র ব্যথায় অসাড় হয়ে আছে।
দিব্য আলোর  টেবিলে ওই রুটি এবং মদ
দীপ্ত হেয়ে  ওঠে।



   ট্রাম্পেট

মুণ্ড- ছাট উইলোর নীচে খেলে বাদামী শিশুরা
উইলোর মাথা জুড়ে সতুন পাতার উদগম,
ট্রাম্পেটের সুর ভেসে যায় ।
কেঁপে ওঠে চার্চ -প্রাঙ্গন।মেপল  বৃক্ষের বিলাপের মধ্যে দিয়ে
গাঢ় লাল পতাকারা আলোড়িত হয়,
বাইরে মাঠের কাছে অশ্বারোহীরা ,
ঘানিগুলো শুন্য পরে আছে।
কিংবা রাতের বেলা গান গায় মেষপালকেরা ,

পুরুষ হরিণগুলো নিজেদের আগুনের আলোর ভিতরে ঢুকে যায় ,
অরণ্যর প্রবীন বিলাপ;
কালো দেয়ালের সামনে নৃত্যশীল মানুষের ভীড় জমে ওঠে;
গাঢ় লাল পতাকায় ,পাগলামিতে,
হাস্য আর ট্রাম্পেটের হল্লায় মুখরিত প্রান্তরখানি।



ঘুম

অভিশপ্ত  কালো বিষ , তুমি,
সাদা ঘুম।
সন্ধ্যার আবরণে বিরল বাগানগুলো
বাদুর , ঊর্ণনাভ,
রাত্রির পোকা আর বিষাক্ত সাপের  দখেলে।

আগন্তুক,সূর্যাস্তের রক্তিমাভায়
তোমার হারানো ছায়া।
বেদনার লোনা দরিয়ায়
বিষন্ন জাহাজ।
অয়োময় বিধ্বস্ত নগরীর উপর দিয়ে
রাত্রির শেষে দিকে সাদা পাখি
উড়ে চলে যায়।

রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৮

কবিতা

কবিতা
খাঁদু দাদু
..........কাজী নজরুর ইসলাম
ও মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা- নাক ড্যাঙ্গা-ড্যাং- ড্যাং!
ওঁর নাকতাকে কে করল খ্যাঁদ্যা রাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে- ছা ব'সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে।
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং।
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

ওঁর খ্যাঁদা নাকের ছ্যাঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় 'টু'!
ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এ রাম! ওয়াক! থুঃ!
কাছিম যেন উপুড় হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

দাদু বুঝি চিনাম্যান মা, নাম বুঝি চাং চু,
তাই বুঝি ওঁর মুখটা অমন চ্যাপটা সুধাংশু।
জাপান দেশের নোটীশ উনি নাকে এঁটেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়- নাক
ঘুম দিলে ঐ চ্যাপটা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ।
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

লম্ফানন্দে লাফ দিয়ে মা চলতে বেঁজির ছা
দাড়ির জালে প'ড়ে দাদুর আটকে গেছে গা,
বিল্লি- বাচ্চা দিল্লি যেতে নাসিক এসেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

দিদিমা কি দাদুর নাকে টাঙাতে 'আলমানাক'
গজাল ঠুঁকে দেছেন ভেঙ্গে বাঁকা নাকের কাঁখ?
মুচি এসে দাদুর আমার নাক করেছেন 'ট্যান'!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।

বাঁশির মতন নাসিকা মা মেলে নাসিকে,
সেথায় নিয়ে চল দাদু দেখন -হাসিকে!
সেথায় গিয়ে করুন দাদু গরুড় দেবের ধ্যান,
খাঁদু দাদু নাকু হবেন, নাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।


তোমারে পড়িছে মনে - প্রেমের কবিতা, বিরহের কবিতা
- কাজী নজরুল ইসলাম
তোমারে পড়িছে মনে
তোমারে পড়িছে মনে
আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,
যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে-
তোমারে পড়িছে মনে।
হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে
ঝিলিমিলি-তলে

ম্লান লুলিত অঞ্ছলে
চাহিয়া বসিয়া আছ একা,
বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।
বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি,
তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।

সিক্ত-পক্ষ পাখী
তোমার চাঁপার ডালে বসিয়া একাকী
হয়ত তেমনি করি, ডাকিছ সাথীরে,
তুমি চাহি' আছ শুধু দূর শৈল-শিরে ।।
তোমার আঁখির ঘন নীলাঞ্জন ছায়া
গগনে গগনে আজ ধরিয়াছে কায়া । ...
আজি হেথা রচি' নব নীপ-মালা--
স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা
অকারণে !-জানি আমি জানি
তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি
রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু
চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু।
বহে আজি দিশাহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন,
তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন,
খুঁজে যায় মোর গীত-সুর

কোথা কোন্ বাতায়নে বসি' তুমি বিরহ-বিধুর।
তোমার গগনে নেভে বারে বারে বিজলীর দীপ,
আমার অঙ্গনে হেথা বিকশিয়া ঝরে যায় নীপ।
তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল,
আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।
আমার বেদনা আজি রূপ ধরি' শত গীত-সুরে
নিখিল বিরহী-কন্ঠে--বিরহিণী--তব তরে ঝুরে!
এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!
তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফুল!
কাজী নজরুল ইসলাম
কাব্যগ্রন্থ - চক্রবাক

.

কবিতা

বিদ্রোহী
--কবি কাজী নজরুল ইসলাম

          বল বীর-
বল উন্নত মম শির !
শির নেহারী আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর! 
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার ‘আসন’ আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির !
আমি চিরদুর্দম,দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ , আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস !
আমি মহাভায় , আমি অভিশাপ পৃথ্বীর ,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার !
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
অামি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল !
আমি মানি না কো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঞড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী -সুত বিশ্ব-বিধাতৃর !

বল বীর-
চির-উন্নত মম শির !
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই , আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাণ্বীর ,আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল ,
আমি চল-চঞ্চল , ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল ;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই  করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’
করি শত্রুর সাথে গলাগলি , ধরি মৃত্যুর  সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা !
আমি মহামারী , আমি ভীতি এ ধরীত্রির ;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির !আমি চির-দূরন্ত দুর্মর
আমি দূর্দম মম প্রাণের  পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ , আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি , আমি ধ্বংস , আমি লোকালয় , আমি শ্মশান,
আমি অবসান , নিশাবসান। আমি ঈন্দ্রাণী -সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য়
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের  বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য ;আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমমেশ , ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল  বাীর -
চির-উন্নত মম শির ! আমি সন্ন্যাসী সুর  সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান  গৈরিক।
অামি বেদুইন , আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া  করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র , আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
অামি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল , ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড !
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বমিত্র-শিষ্য,
আমিদাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ -খোলা  হাসি উল্লাস, আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত , কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ , আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের  উচ্ছাস আমি বরিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল , আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল! আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী , তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম , আমি ধন্যি ! আমি উন্মন, মন-উদাসীর ,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের ,
আমি অবমানিতের  মরম-বেদনা , বিষ-জ্বালা , প্রিয় লাঞ্ছিতি বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা , ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর -কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর !
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা , তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির শিশু, চির কিশোর ,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচল কাচুলি নিচোর !
আমি উত্তর-বায়ু মলয় -অনিল  উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির ,গভীর রাগিণী,বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা ,  আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি , এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ !
আমি সহসা আমারে চিনেছি , আমার খুলিয়া  গিয়াছে সব বাঁধ ! আমি উহ্থান, আমি পতন , আমি অচেতন
চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী , মানব -বিজয় -কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে ,
তাজী বোরবাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলো ! আমি বসুধা -বক্ষে আগ্রেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল ,
আমি পাতালে মাতাল ,অগ্নি-পাথার -কলরোল-কল কোলাহল !
আমি তড়িতে চড়িয়া , উড়ে চলি  জোড় তুড়ি দিয় দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি, ভুবনে সহসা , সঞ্চারি ভূমিকম্প। ধরি বাসুকির ফণা জাপটি-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের  পাখা সাপটি। আমি দেবশিশু , আমি চঞ্চল ,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া  ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের  বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি।
আমি শ্যমের হাতের বাঁশরী । আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া ,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখে নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া !
আমি বিদ্রোহ-বাহী  নিখিল অখিল ব্যাপিয়া ! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে কর বরণীয়া, কভূ বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষহইতে যুগল কন্যা !
আমি অন্যায় , আমি উল্কা , আমি শনি,
আমি ধুমকেতু জ্বলা,  বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী , আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে  বসিয়া হাসি পুস্পের হাসি ! আমি মৃন্ময় , আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয় ,  আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির -দুর্জয়,
জগদীশ্বর -ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ--পাতাল মর্ত্যে!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ।
আমি সহসা আমারে চিনেছি , আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধা !
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার ,
        নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদারা!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল ,আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না ,
অত্যাচারীর খকড়গ কৃপাণ ভমি রণ -ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত !
আমি বিদ্রোহী ভূগু, ভগবান বুকে ্ এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্ট্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন !
আমি চির -বিদ্রোহী বীর-
        বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !
[অগ্নি-বীণা]

wkpdm=nor-c,nora.toua
-------🌿------

সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

হেলাল হাফিজ




অচল প্রেমের পদ্য -২

  ----- হেলাল হাফিজ 
কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিক দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে ?


২.ফেরীঅলা

 ----- হেলাল হাফিজ
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট!
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট ,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
মালটি-কালার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট

ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।

প্রেমের কষ্ট ঘৃনার  কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজেনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

অার কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল  এমন
আমার মত ক জনের আর
সব হয়েছে   নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।

১৩অচল প্রেমের পদ্য

তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ ? তোমার যে যন্ত্রনা
খুব মামুলী ,বেশ করেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা

আল মাহমুদ  

               -নোলক

আমার মায়ের সোনার  নোলক হারিয়ে গেল শেষে 
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে। 
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তুমার কাছে?
-হাত দিও না আমার  শরীর ভরা বোয়ল মাছে। 
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে। 

জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে িই মিনতি ,  ফিরিয়ে দেবে ভাই ,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরেক যেতে চাই ্
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমার  তো সা পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো।
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও , হাত পাতো হাত পাতো -
বলে পাহাড় দেখায় তাহার  আহার ভরা বুক।
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন , ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।


হঠাৎ নীরার জন্য 
..........সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি
আজই কি ফিরেছো?
স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন
তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো,
অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা।

এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।

বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই,
বাড়িতে আসবেন!’

রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল।
‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে
কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে
সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন
ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে
পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়।

বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।।
কাব্যগ্রন্থঃ-আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি


অন্ধ বধূ

..যতীন্দ্রমোহন বাগচী

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি —
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?
তাইত বলি, বদোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল — মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল — কতই মনে হয় ।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই —
আমের গায়ে বরণ দেখা যায় ?
—অনেক দেরি? কেমন করে’ হবে !
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া —বন্ধ কবে ভাই ;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে —
শেওলা-পিছল — এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয়না কিন্তু তায় —
অন্ধ চোখের দ্বন্ধ চুকে’ যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্ ,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা —দাদা তো তার আগে?
এই আষাড়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে’ না পাবে —
দেখবি তখন —প্রবাস কেমন লাগে ?
—কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল ?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল !
কত লোকেই যায় তো পরবাসে —
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে ?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ !
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর —
ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ !
—ঐ যে হথায় ঘরের কাঁটা আছে —
ফিরে’ আসতে হবে তো তার কাছে !
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল-ভারি — ফসকে যদি যাই —
এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে !
আসুন ফিরে’ — অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা —
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’ —
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
‘চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হ’ল সারা।
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা —
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার — ছাই!
কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
‌‌‍‍‍‌’চোখ’ গেল– তার ভরসা তবু আছে —
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে !
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি —
সেই তো ফিরে’ যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ —
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে —
দরদ-ভরা দুখের আলাপন
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত !
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে —
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে —
সকল বালাই বহি আপন মাথায় ! —
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে – এই শেওলা-দীঘির ধার —
সঙ্গে আসতে বলবনা’ক আর,
শেষের পথে কিসের বল’ ভয় —
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে —
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।
শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে —
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে !







 মন ভালো নেই 
--সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায় 
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই           
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী             
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায় ..







লিচু-চোর
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম

বাবুদের তাল -পুকুরে
হাবুদের  ডাল-কুকুরে
সেকি বাস্ ক’রলে তাড়া
বলি থাম্ একটু দাঁড়া !
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না ,
হোতা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চ’ড়েছি,
ছোট এক ডাল ধ’রেছি,
ও বাবা, মড়াৎ ক’রে
প’ড়েছি সড়াৎ জোড়ে!
প’ড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই

ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার ,
ধমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি’!
আমিও বাগিয়ে থাপড়,
দে হাওয়া চগিয়ে কাপড়,
লাফিয়ে ডিঙ্ নু  দেয়াল,
দেখি এক ভিটবে শেয়াল !
আরে ধ্যাৎ শেয়াল কোথা ?
ভেলোটা দাঁড়িয়ে হোথা !
দেখে যেই আঁৎকে ওঠা
কুকুরও জুড়লে ছোটা
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই ক’রবে সাবাড়!
বাবা গো মাগো ব’লে
পাঁচিলের ফোঁকল গ’লে
ঢুকি গ্যে বোসদের  ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!
যাব ফের ? কান মলি ভাই ,
চুরিতে আর যদি যাই !
তবে মোর নামই মিছা !
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায় রে ভুলা--
মালীর ঐ পিটনিগুলো ,
কি বলিস ? ফের হপ্তা ?
তওবা-- নাক-খপতা !

[ঝিঙে ফুল ]