“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ”
“এতক্ষণে”– অরিন্দম কহিলা বিষাদে,
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী!
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ! শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;-
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসের! শাস্তি নরাধমে।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পন করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,- ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; – কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,- এ সকলে দিলা
লেখক: মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম: ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ সাল জন্মস্থান: সাগরদাঁড়ি গ্রাম, যশোর জেলা পিতা: রাজনারায়ণ দত্ত মাতা: জাহ্নবী দেবী *১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ – কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি *১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দ – হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ। এবং হিন্দু কলেজ ছেড়ে দিয়ে শিবপুরের বিশপস কলেজে ভর্তি হন অবদান: অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন, বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের প্রবর্তন উল্লেখযোগ্য রচনা: কৃষ্ণকুমারী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (প্রহসন), মেঘনাদবধ কাব্য (কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যু: ২৯ জুন, ১৮৭৩ সাল
“এতক্ষণে”– অরিন্দম কহিলা বিষাদে,
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী!
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ! শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
এইখানে ক্লিক করুন
[ এতক্ষণে জানতে পারলাম লক্ষণ কী করে এই রাক্ষসপুরের ভিতরে প্রবেশ করলো , হায় চাচা ,একাজ করা কি উচিৎ তোমার মা হচ্ছে সতী নিকষা এব্ং ভাই শ্রেষ্ঠ রাক্ষস রাবণ । মহাদেব বা শিবের মত ভাই কুম্ভকর্ন, ভাইয়ের ছেলে সে [মেঘনাদ] নিজে হচ্ছে ইন্দ্রবিজয়ী ]
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
এইখানে ক্লিক করুন
[ নিজের ঘরের পথ কাকা তুমি দেখাও চোরকে. চন্ডালকে (নিচুশ্রেণীর) রাজার বাড়ীতে বসাও, তুমি পৃতৃতুল্য তোমাকে তিরস্কার করিব না ছাড় দাড় যাব অস্ত্রাগারে ]
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
এইখানে ক্লিক করুন
[ রামের ভাই লক্ষণকে আজ মৃত্যুপুরীতে পাঠিয়ে লঙ্কার কলঙ্ক আজ মোচন করিব যুদ্ধের দ্বারা ]
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;-
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
এইখানে ক্লিক করুন [বিভীষণ উত্তর দিল তোমার এ প্রয়াস বৃথা {মেঘনাদ} আমি হলাম রামের দাস কিভাবে তোমার অনুরোধ রক্ষা করিব,কাতর স্বরে উত্তর দিল রাবনের পুত্র মেঘনাদ পিতৃব্য, আপনার কথা শুনে মরতে ইচ্ছা করছে]
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
এইখানে ক্লিক করুন
[রামচন্দ্রের দাস তুমি কেমনে একথা মুখে আনতে পারলে আমাকে বল চাচা]
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?
এইখানে ক্লিক করুন
[ চাঁদকে বিধাতা সৃষ্টি করে আকাশের ললাটে স্থাপন করেছেন আকাশের চাঁদ কখনো ভূতলে ধূলায় গড়াগড়ি খায়না, তাই উচ্চ বংশের বিভীষণকে রাম-লক্ষ্মণের সাথে বন্ধুত্ব করা মানায় না। হে রাক্ষসকুলের বীরকে তা কী করে ভুলে গেলেন? রক্ষোরথি: রাক্ষসকুলের বীরমহাকুলে: উচ্চবংশ]
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
এইখানে ক্লিক করুন
[ কে সে অধম সুন্দর জলাশয়ে জলহাঁসের সাথে খেলাকরে সে কখনও কর্দমাক্ত মাটিতে শ্যাওলাভারা বদ্ধজলাশয়ে গোসল করে না ]
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
এইখানে ক্লিক করুন
[ কেশরযুক্ত পশুরাজ সিংহ কখনো শিয়ালকে বন্ধু করে নেয় না। বিভীষণ এখানে সিংহ এবং রাম-লক্ষ্মণ শিয়ালতুল্য। আমি তোমার অজ্ঞদাস। তুমি তো বিজ্ঞ। তোমার তো কিছু অজানা নেই ]
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
এইখানে ক্লিক করুন
[ লক্ষণ নিতান্তই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রমনা বীর। নাহলে কি সে অস্ত্রহীনকে যুদ্ধে আহবান জানায়? ]
ক্ষুদ্রমতি নর: ক্ষুদ্রমনা মানুষ, শূর: শক্তিমান
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
এইখানে ক্লিক করুন
[বলো বীর, এটা বীরের প্রথা? লঙ্কাপুরীতে এমন কোনো শিশু নেই যে এ কথা শুনে হাসতো না। পথ ছেড়ে দাও। এখনি ফিরে আসবো। দেখবো, কোন্ দৈব ক্ষমতাবলে সুমিত্রার সন্তান লক্ষ্মণ আমাকে বাঁধা দেয়।
বিমুখে: রুখে দেয় সৌমিত্রি: সুচিত্রার সন্তান- লক্ষ্মণ ]
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
এইখানে ক্লিক করুন [দেবতা, দৈত্যের, নরের যুদ্ধে আমার পরাক্রম বা ক্ষমতা তুমি দেখেছো। কী দেখে তোমার এরকম একজন দুর্বল মানুষকে দেখে তোমার এদাস ভয় পাবে।]
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসের! শাস্তি নরাধমে।
এইখানে ক্লিক করুন
[মেঘনাদের যজ্ঞ বা পূজার স্থান।দম্ভ সহকারে প্রবেশ করে এবং চাচা বিভীষনের নিকট হতে লক্ষণকে শাস্তিদেওয়ার জন্য অনুমতি চান।] এখানে অগ্নিদেবের পূজারত অবস্থায় অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদ নিহত হয়।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পন করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,- ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
এইখানে ক্লিক করুন
[হে পিতৃব্য, তোমার জন্মভূমিতে এক বনবাসী ঢুকে পড়েছে।হে বিধানকর্তা, স্বর্গীয় উদ্যানে এক দুরাচার দৈত্য ভ্রমণ করছে ফুটন্ত পদ্মফুলে এক কীট ঢুকে পড়েছে। বলো পিতৃব্য, তোমার ভাতৃপুত্র হয়ে এ অপমান আমি কী করে সইবো।তুমিই বা কিভাবে সহিতেছে ]
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে
এইখানে ক্লিক করুন
[প্রচণ্ড মন্ত্রের শক্তিতে সাপ লজ্জায় যেভাবে মাথানত করে, রাবণের ছোটভাই বিভীষণও তেমনি মাথানত করে মেঘনাদকে লক্ষ করে উত্তর দিল, “হে বৎস আমি দোষী নই। অহেতুক তুমি আমাকে দোষী করছো।
ভর্ৎস: ভর্ৎসনা বা তিরষ্কার করে ]
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
এইখানে ক্লিক করুন
[নিজ কর্মদোষে এ স্বর্ণালঙ্কার রাজা লঙ্কাকে মজিয়েছে এবং নিজেও মজেছে।কনক-লঙ্কা: স্বর্ণালঙ্কা দেবকূল সর্বদা পাপ থেকে দূরে থাকে, কিন্তু আজ লঙ্কাপুরী পাপে পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রলয় বা ঝড়ে যেভাবে পৃথিবী ধ্বংস হয়, যেভাবে লক্ষ্মণ যেন এক অশুভ কালজলে নিমজ্জিত হচ্ছে।
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
এইখানে ক্লিক করুন
[সেজন্য আমি রামের পায়ের কাছে আশ্রুয় নিয়েছি। পরের দোষে আমি কেন মগ্ন হবো? সেজন্য এ কথাশুনে মেঘনাদ{বাসবত্রাস} রাগান্বিত হয়ে উঠে]
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; – কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,- এ সকলে দিলা
এইখানে ক্লিক করুন
[ রাতে আকাশে যেভাবে ভয়ানকরূপে মেঘ গর্জে ওঠে সেভাবে বীর বলবান (মেঘনাদ) বললো, হে ধর্মগামী, তুমি কোন ধর্মমতে জাতি, কুল সম্পর্ক সব বিসর্জন দিলে? ]
অম্বরে:= আকাশে ,মন্দ্রে:= শব্দে বা ধ্বনিতে
জীমূতেন্দ্র:= মেঘের ডাক
কোপি:= গর্জে ওঠে
বীরেন্দ্র বলী:= বীর বলজন
রাক্ষসরাজানুজ:=রাক্ষস রাজার অনুজ বা রাক্ষসের ছোটভাই
জ্ঞাতিত্ব:= মানবসম্পর্ক , জলাঞ্জলি:= বিসর্জন দেয়া)
অম্বরে:= আকাশে ,মন্দ্রে:= শব্দে বা ধ্বনিতে
জীমূতেন্দ্র:= মেঘের ডাক
কোপি:= গর্জে ওঠে
বীরেন্দ্র বলী:= বীর বলজন
রাক্ষসরাজানুজ:=রাক্ষস রাজার অনুজ বা রাক্ষসের ছোটভাই
জ্ঞাতিত্ব:= মানবসম্পর্ক , জলাঞ্জলি:= বিসর্জন দেয়া)
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজনে, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
এইখানে ক্লিক করুন
[শাস্ত্রে বলা হয়েছে, গুণবান পরজনের চেয়ে নির্গুণ স্বজন উত্তম। পর সবসময় পর থাকে। এই যে আত্মীয় স্বজনকে ত্যাগ করার শিক্ষা, হে রাক্ষসকূলের কর্তা, তুমি কোথায় শিখিলে]
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।”
এইখানে ক্লিক করুন ✿
[কিন্তু অহেতুক তোমাকে তিরস্কার করছি। যাদের সঙ্গে তুমি বন্ধুত্ব করে বসবাস করছো, তাদের কাছে বর্বরতা তুমি কেনই বা শিখবে না? নীচ প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে যার বসবাস, তার মন তো নীচ হবেই।]
মূলভাব:
আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা মানুষ মানবতার জয় গান গেয়েছেন। পুরানো বিভীষণ চরিত্রের বিশ্বাসঘাতকতার স্বরুপ উন্মোচন পূর্বক মেঘনাদের মাধ্যমে কবির স্বদেশের প্রতি গভীর প্রেম,ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ-ই হলো ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কাব্যাংশের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
মূলভাব :
বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে রাবণের ছেলে মেঘনাদ এর সাথে তার চাচা বিভীষণের কথোপকথন হচ্ছে। রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধে বিভীষণ স্বপক্ষ ত্যাগ করে এবং রামের দলে যোগ দেয়। যুদ্ধের আগে মেঘনাদ যখন তার জজ্ঞাগারে যায় প্রার্থনা করতে, তখন বিভীষণের সাহায্যে সেখানে লক্ষ্মণও প্রবেশ করে এবং নিরস্ত্র মেঘনাদকে যুদ্ধের জন্য আহবান করে। মেঘনাদ তখন দেখতে পায় দরজায় তারি চাচা বিভীষণ দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে সব ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে এবং তার চাচাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলে। তখন তাদের মাঝে যে কথোপকথন হয়।
পাঠ পরিচিতির জন্য:- এইখানে দেখুন
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কাব্যাংশটুকু মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র ‘বধো’ (বধ) নামক ষষ্ঠ সর্গ থেকে সংকলিত হয়েছে।সর্বমোট নয়টি সর্গে বিন্যস্ত ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র ষষ্ঠ সর্গে লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে অসমসাহসী বীর মেঘনাদের। রামচন্দ্র কর্তৃক দ্বীপরাজ্য স্বর্ণলঙ্কা আক্রান্ত হলে রাজা রাবণ শত্রুর উপর্যুপরি দৈব-কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদকে পিতা রাবণ পরবর্তী দিবসে অনুষ্ঠেয় মহাযুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে বরণ করে নেন। যুদ্ধজয় নিশ্চিত করার জন্য মেঘনাদ যুদ্ধযাত্রার পূর্বেই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইষ্টদেবতা অগ্নিদেবের পূজা সম্পন্ন করতে মনস্থির করে। মায়া দেবীর আনুকূল্যে এবং রাবণের অনুজ বিভীষণের সহায়তায়, লক্ষ্মণ শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। কপট লক্ষ্মণ নিরস্ত্র মেঘনাদের কাছে যুদ্ধ প্রার্থনা করলে মেঘনাদ বিস্ময় প্রকাশ করে। শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশ যে মায়াবলে সম্পন্ন হয়েছে, বুঝতে বিলম্ব ঘটে না তার।
ইতোমধ্যে লক্ষ্মণ তলোয়ার কোষমুক্ত করলে মেঘনাদ যুদ্ধসাজ গ্রহণের জন্য সময় প্রার্থনা করে লক্ষ্মণের কাছে। কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে সময় না দিয়ে আক্রমণ করে। এ সময়ই অকস্মাৎ যজ্ঞাগারের প্রবেশদ্বারের দিকে চোখ পড়ে মেঘনাদের; দেখতে পায় বীরযোদ্ধা পিতৃব্য বিভীষণকে। মূহুর্তে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে। খুল্লতাত বিভীষণকে প্রত্যক্ষ করে দেশপ্রেমিক নিরস্ত্র মেঘনাদ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, সেই নাটকীয় ভাষ্যই “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” অংশে সংকলিত হয়েছে। এ অংশে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রেহিতার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে ঘৃণা। জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও জাতিসত্তার সংহতির গুরুত্বের কথা যেমন এখানে ব্যক্ত হয়েছে তেমনি এর বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রকে অভিহিত করা হয়েছে নীচতা ও বর্বরতা বলে।
উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাল্মীকি-রামায়ণকে নবমূল্য দান করেছেন এ কাব্যে। মানবকেন্দ্রিকতাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সারকথা। ওই নবজাগরণের প্রেরণাতেই রামায়ণের রাম-লক্ষ্মণ মধুসূদনের লেখনীতে হীনরূপে এবং রাক্ষসরাজ রাবণ ও তার পুত্র মেঘনাদ যাবতীয় মানবীয় গুণের ধারকরূপে উপস্থাপিত। দেবতাদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাম-লক্ষ্মণ নয়, পুরাণের রাক্ষসর্জ রাবণ ও তার পুত্র মেঘনাদের প্রতিই মধুসূদনের মমতা ও শ্রদ্ধা। “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কাব্যাংশটি ১৪ মাত্রার অমিল প্রবহমান যতিস্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রথম পঙক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় পঙক্তির চরণান্তের মিলহীনতার কারণে এ ছন্দ ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ নামে সমধিক পরিচিত। এ কাব্যাংশের প্রতিটি পঙক্তি ১৪ মাত্রায় এবং ৮+৬ মাত্রার দুটি পর্বে বিন্যস্ত। লক্ষ করার বিষয় যে, এখানে দুই পঙক্তির চরণাধিক মিলই কেবল পরিহার করা হয়নি, যতিপাত বা বিরামচিহ্নের স্বাধীন ব্যবহারও হয়েছে বিষয় বা বক্তব্যের অর্থের অনুষঙ্গে। এ কারণে ভাবপ্রকাশের প্রবহমানতাও কাব্যাংশটির ছন্দেরবিশেষ লক্ষ্মণ হিসেবে বিবেচ্য
mozahid
10/7/2018,thuesday