লেখক পরিচিতি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলাকথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার।
কথা শিল্পী চট্টগ্রাম জেলার ষোলোশহরে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পিতৃনিবাস ছিল নোয়াখালীতে।
তাঁর পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা
অল্প বয়সে মাতৃহীন হওয়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন্
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে করাচি বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন।
এরপর তিনি কূটনৈতিক দায়িত্বে নয়াদিল্লি, ঢাকা, সিডনি, করাচি, জাকার্তা, বন, লন্ডন এবং প্যারিসে নানা পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল প্যারিস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অক্টোবরে তিনি প্যারিসে পরলোক গমন করেন।
তার গল্প গন্থ: ‘নয়নচারা’ (১৯৪৬), ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৫)
উপন্যাস: ‘লালসালু’ (১৯৪৮) ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) ও কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
নাটকও হলো: ‘বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’, ‘উজানে মৃত্যু’ ও ‘সুড়ঙ্গ’।
‘লালসালু’র প্রকাশতথ্য
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে লালসালু’ প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকার কমরেড পাবলিশার্স এটি প্রকাশ করে। প্রকাশক মুহাম্মদ আতাউল্লাহ।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর,
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নওরোজ কিতাবিস্তান ‘লালসালু’ উপন্যাসের দশম মুদ্রণ প্রকাশ করে।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘লালসালু’ উপন্যাসের উর্দু অনুবাদ করাচি থেকে প্রকাশিত হয় ‘Lal Shalu’ নামে। অনুবাদক ছিলেন কলিমুল্লাহ।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’র ফরাসি অনুবাদ। L Arbre sans racines’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি অনুবাদ করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সহধর্মিণী অ্যান-মারি-থিরো।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এ অনুবাদটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। `Tree without Roots’ নামে লন্ডনের Chatto and Windus Ltd. এটি প্রকাশ করেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজেই এই ইংরেজি অনুবাদ করেন।
পরবর্তীকালে ‘লালসালু’ উপন্যাসটি জার্মান ও চেক ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
চরিত্র-সৃষ্টি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে অসাধারণ কুশলী শিল্পী তা তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসের শৈল্পিক সার্থকতার প্রশ্নে সুসংহত কাহিনিবিন্যাসের চাইতে চরিত্র নির্মাণের কুশলতার দিকটি ভূমিকা রেখেছে অনেক বেশি। ‘লালসালু’ একদিক দিয়ে চরিত্র-নির্ভর উপন্যাস।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় ও শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন; বরবার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন। উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
মজিদ একটি প্রতীকী চরিত্র-কুসংস্কার, শটতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবন্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে যে-কোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক। একান্ত পারিবারিক ঘটনার রেশ ধরে সে প্রথমেই বৃদ্ধ তাহেরের বাবাকে এমন এক বিপাকে ফেলে যে সে নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়। নিজের মাজারকেন্দ্রিক শক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ অনুভব করে সে আওয়ালপুরের পির সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। ব্যাপারটি রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায় এবং নাস্তানাবুদ পির সাহেবকে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে সে বাধ্য করে। সে খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করে তার সন্তান-আকাঙ্ক্ষী প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে। আর আক্কাস নামের এক নবীন যুবকের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। এ ভাবেই মজিদ তার প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠাকে নিরঙ্কুশ করে তোলে।
মহব্বতনগরে মজিদ তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করলেও এর ওপর যে আঘাত আসতে পারে সে বিষয়ে মজিদ অত্যন্ত সজাগ। সে জানে, স্বাভাবিক প্রাণধর্মই তার ধর্মীয় অনুশাসন এবং শোষণের অদৃশ্য বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। ফলে ফসল ওঠার সময় যখন গ্রামবাসীরা আনন্দে গান গেয়ে ওঠে তখন সেই গান তাকে বিচলিত করে। ওই গান সে বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। রহিমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় সে বাধা দেয়। আক্কাস আলিকে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত অপমানিত করে। মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজের জাগতিক প্রতিষ্ঠার ভিতটিকে মজবুত করার জন্যে এ সবই আসলে তার হিসেবি বুদ্ধির কাজ। সে ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তার বিশ্বাস সুদৃঢ় কিন্তু প্রতারণা বা ভণ্ডামির মাধ্যমে যেভাবেই হোক সে তার মাজারকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এরপরও মাঝে মাঝে তার মধ্যে হতাশা ভর করে। মজিদ কখনো কখনো তার প্রতি মানুষের অনাস্থা অবলোকন করে নিজের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। একেকবার আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভাবে। মাজার প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে কূট-কৌশল অবলম্বন করেছে তার সব কিছু ফাঁস করে দিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবে।
প্রতিষ্ঠাকামী মজিদ স্বার্থপরতা, প্রতিপত্তি আর শোষণের প্রতিভূ। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের পর নিঃসন্তান জীবনে সে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একপ্রকার শূন্যতা উপলব্ধি করে। এই শূন্যতা পূরণের অভিপ্রায়ে অল্পবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে সে। প্রথম স্ত্রী রহিমার মতো দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা ধর্মের ভয়ে ভীত নয়। এমনকি, মাজারভীতি কিংবা মাজারের অধিকর্তা মজিদ সম্পর্কেও সে কোনো ভীতি বোধ করে না। তারুণ্যের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তার মধ্যে জীবনের চঞ্চলতা ও উচ্ছলতা অব্যাহত থাকে। মজিদ তাকে ধর্মভীতি দিয়ে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়। জমিলা তার মুখে থুথু দিলে ভয়ানক ক্রুদ্ধ মজিদ তাকে কঠিন শাস্তি দেয়। তার মানবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র না হয়ে তার ক্ষমতাবান সত্তাটি নিষ্ঠুর শাসনের মধ্যেই পরিতৃপ্তি খোঁজে। রহিমা যখন পরম মমতায় মাজার ঘর থেকে জমিলাকে এনে শুশ্রূষা আরম্ভ করে তখন মজিদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় তুমূল আলোড়ন। মজিদের মনে হয়, ‘মুহূর্তের মধ্যে কেয়ামত হবে। মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেনো ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম হয়’। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হয়। নবজন্ম হয় না তার। মজিদ শেষ পর্যন্ত থেকে যায় জীবনবিরোধী শোষক এবং প্রতারকের ভূমিকায়।
মজিদ একটি নিঃসঙ্গ চরিত্র। উপন্যাসেও একাধিকবার তার ভয়নাক নৈঃসঙ্গ্যবোধের কথা বলা হয়েছে? তার কোনো আপনজন নেই যার সঙ্গে সে তার মনের একান্তভাব বিনিময় করতে পারে। কারণ, তাঁর সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক কেবলই বাইরের- কখনো প্রভাব বিস্তারের বা নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব আরোপের- কখনোই অন্তরের বা আবেগের নয়। সে কখনোই আবেগী হতে পারে না। কারণ তার জানা আছে আন্তরিকতা ও আবেগময়তা তার পতনের সূচনা করবে। আর তাতেই ধসে পড়তে পারে তিলতিল করে গড়ে তোলা তার মিথ্যার সাম্রাজ্য।
এসব সত্ত্বেও মজিদ যে আসলেই দুর্বল এবং নিঃসঙ্গ- এই সত্য ধরা পড়ে রহিমার কাছে। ঝড়ের রাতে জমিলাকে শাসনে ব্যর্থ হয়ে মজিদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কীভাবে তরুণী বধূ জমিলাকে সে নিয়ন্ত্রণে রাখবে সেই চিন্তায় একেবারে দিশেহারা বোধ করে। এরূপ অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবনে প্রথম হয়ত তার মধ্যে আত্মপরাভবের সৃষ্টি হয়। নিজের শাসক-সত্তার কথা ভুলে গিয়ে রহিমার সামনে মেলে ধরে ব্যর্থতার আত্মবিশ্লেষণমূলক স্বরূপ। ‘কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?’ ওই ঘটনাতেই রহিমা বুঝতে পারে তার স্বামীর দুর্বলতা কোথায় এবং তখন ভয়, শ্রদ্ধা এবং ভক্তির মানুষটি তার কাছে পরিণত হয় করুণার পাত্রে।
খালেক ব্যাপারী ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র। ভূ-স্বামী ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর কাঁধেই রয়েছে মহব্বতনগরের সামাজিক নেতৃত্ব। উৎসব-ব্রত, ধর্মকর্ম, বিচার-সালিশসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যেখানে তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়। নিরাক-পড়া এক মধ্যাহ্নে গ্রামে আগত ভণ্ড মজিদ তার বাড়িতেই আশ্রয় গ্রহণ করে। একসময় যখন সমাজে মজিদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন খালেক ব্যাপারী ও মজিদ পরস্পর বজায় রেখেছে তাদের অলিখিত যোগসাজশ।
অবশ্য নিয়মও তাই। ভূ-স্বামী ও তথাকথিত ধর্মীয় মোল্লা-পুরোহিতদের মধ্যে স্ব স্ব প্রয়োজনে অনিবার্যভাবে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য। কারণ দুদলের ভূমিকাই যে শোষকের। আসলে মজিদ ও খালেক ব্যাপারী দুজনেই জানে: ‘অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটা পথে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেকজনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক। হাজার বছর ধরেই শোষক শ্রেণির অপকর্মের চিরসাথী ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা সম্মিলিত উদ্যোগে সমাজে টিকিয়ে রাখে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার। শিক্ষার আলো, যুক্তবুদ্ধির চর্চা ও অধিকারবোধ সৃষ্টির পথে তৈরি করে পাহাড়সম বাধা- যাতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত থাকে বিকশিত মানব চেতনা থেকে। এরই ফলে সফল হয় শোষক। শুধু ভূস্বামী শোষক কেন, যে কোনো ধরনের শোষকের ক্ষেত্রে একথা সত্য। তারা শোষণের স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। একারণেই মজিদের সকল কর্মকাণ্ডে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছে খালেক ব্যাপারী। এমনকি মজিদের প্রভাব প্রতিপত্তিও মেনে নিয়েছে অবনত মস্তকে; যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিজের একান্ত প্রিয় প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবিকে তালাক দেয়া।
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খালেক ব্যাপারীর উপস্থিতি থাকলেও সে কখনোই আত্মমর্যাদাশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা জানি যে, ধর্মব্যবসায়ীরা আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হিসেবে জাহির করে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভূত্ব করে। ফলে শোষকরাও তাদের অধীন হয়ে যায়। কিন্তু শোষকদের হাতে যেহেতু থাকে অর্থ সেহেতু তারাও ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থের শক্তিতে অধীন করে ফেলে। কিন্তু এখানে খালেক ব্যাপারীর চরিত্রে আমরা সে দৃঢ়তা কখনোই লক্ষ করি না। বরং প্রায় সব ক্ষেত্রেই মজিদের কথার সুরে তাকে সুর মেলাতে দেখা যায়। ফলে মজিদ চরিত্রের সঙ্গে সে কখনো দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়নি। তার অর্থের শক্তির সবসময় মাজার-শক্তির অধীনতা স্বীকার করেছে। তাঁর এই চারিত্রিক দৌর্বল্য ইতিহাসের ধারা থেকেও ব্যতিক্রমী।
মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। লম্বা চওড়া শারীরিক শক্তিসম্পন্না এই নারী পুরো উপন্যাস জুড়ে স্বামীর ব্যক্তিত্বের কাছে অসহায় হয়ে থাকলেও তার চরিত্রের একটি স্বতন্ত্র মাধুর্য আছে। লেখক নিজেই কার শক্তিমত্তাকে বাইরের খোলস বলেছেন, তাকে ঠান্ডা ভীতু মানুষ বলে পরিচিতি দিয়েছেন। তার এই ভীতি-বিহবল, নরম কোমল শান্ত রূপের পেছনে সক্রিয় রয়েছে ঈশ্বর-বিশ্বাস, মাজার-বিশ্বাস এবং মাজারের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তি। ধর্মভীরু মানুষেরা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের কারণে যে কোমল স্বভাবসম্পন্ন হয় রহিমা তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমগ্র মহব্বতনগরের বিশ্বাসী মানুষদেরই সে এক যোগ্য প্রতিনিধি। স্বামী সম্পর্কে মাজার সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্নের উদয় হয় না, সে সর্বদাই নিদ্বির্ধায় মেনে নেয় স্বামীর মুখ থেকে উচ্চারিত ধর্মের সকল বিধান। মাজার সংক্রান্ত সকল কাজকর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং তার নিজের সকল গার্হস্থ্য কর্ম প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই সে একান্তভাবে সৎ এবং নিয়মনিষ্ঠ। মাজার নিয়ে যেমন রয়েছে তার ভীতি ও ভক্তি, তেমনি এই মাজারের প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবেও রয়েছে তার মর্যাদা বোধ। এই মর্যাদাবোধ থেকেই সে গ্রামের মাজার ও মাজারের প্রতিনিধি সম্পর্কে গুণকীর্তন করে, তার শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস তুলে ধরে এবং এভাবে সে নিজেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। হাসুনির মায়ের সমস্যা যখন সে তার স্বামীর কাছে জানায় কিংবা আমেনা বিবির সংকট মুহূর্তে তার পাশে গিয়ে অবস্থান নেয় তখন তার মধ্যে মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে গর্ববোধ কাজ করে। এ গর্ববোধ ছাড়াও এখানে সক্রিয় থাকে নারীর প্রতি তার একটি সহানুভূতিশীল মন। রহিমার মনটি স্বামী মজিদের তুলনায় একেবারেই বিপরীতমুখী।
মজিদের কর্তৃত্বপরায়ণতা, মানুষের ধর্মভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগের দূরভিসন্ধি প্রভৃতির বিপরীতে রহিমার মধ্যে সক্রিয় থাকে কোমল হৃদয়ের এক মাতৃময়ী নারী। সেটি জমিলা প্রসঙ্গে লক্ষ করা যায়। তাদের সন্তানহীন দাম্পত্য-জীবনে মজিদ যখন দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব করে তখন রহিমার মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি হয় না। এর মূলে সক্রিয় তার স্বামীর প্রতি অটল ভক্তি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং সরল ধর্মনিষ্ঠা। কিন্তু জমিলা যখন তার সতীন হিসেবে সংসারে আসে তখনও সামাজিক গার্হস্থ্য বাস্তবতার কারণে যেটুকু ঈর্ষা সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন ছিল তাও অনুপস্থিত থাকে তার ওই হৃদয়সংবেদী মাতৃমনের কারণে। জমিলা তার কাছে সপত্নী হিসেবে বিবেচিত হয় না বরং তার মাতৃহৃদয়ের কাছে সন্তানতুল্য বলে বিবেচিত হয়। এ পর্যায়ে জমিলাকে কেন্দ্র করে তার মাতৃত্বের বিকাশটি পূর্ণতা অর্জন করে যখন মজিদ জমিলার প্রতি শাসনের খড়গ তুলে ধরে।
স্বামীর সকল আদেশ নির্দেশ উপদেশ সে যেভাবে পালন করেছে সেইভাবে জমিলাও পালন করুক সেটি সেও চায় কিন্তু সে পালনের ব্যাপারে স্বামীর জোর-জবরদস্তিকে সে পছন্দ করে না। স্বামীর প্রতি তার দীর্ঘদিনের যে অটল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এক্ষেত্রে তাতে ফাটল ধরে। এক্ষেত্রে তার ধর্মভীরুতাকে অতিক্রম করে মুখ্য হয়ে ওঠে নিপীড়িত নারীর প্রতি তার মাতৃহৃদয়ের সহানুভূতি। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয়েছিল ব্যক্তিত্বহীন, একমাত্র আনুগত্যের মধ্যেই ছিল যার জীবনের সার্থকতা, সেই নারীই উপন্যাসের শেষে এসে তার মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বময় হয়ে ওঠে। রহিমা চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখানেই লেখকের সার্থকতা।
নিঃসন্তান মজিদের সন্তান-কামনাসূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে আগমন ঘটে জমিলার। শুধু সন্তান-কামনাই তার মধ্যে একমাত্র ছিল কীনা, নাকি তরুণী স্ত্রী-প্রত্যাশাও তার মাঝে সক্রিয় ছিল তা লেখক স্পষ্ট করেননি। কিন্তু বাস্তবে আমরা লক্ষ করি তার গৃহে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে যার আগমন ঘটে সে তার কন্যার বয়সী এক কিশোরী। জমিলার চরিত্রে কৈশোরক চপলতাই প্রধান। এই চপলতার কারণেই দাম্পত্য সম্পর্কে গাম্ভীর্য তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি তার পত্নী রহিমাও তার কাছে কখনো ঈর্ষার বিষয় হয়ে ওঠে না। রহিমা তার কাছে মাতৃসম বড়বোন হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং তার কাছ থেকে সে তদ্রূপ স্নেহ আদর পেয়ে অভিমান-কাতর থাকে। রহিমার সামান্য শাসনেও তার চোখে জল আসে। তার ধর্মকর্ম পালন কিংবা মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে তার যেরূপ গাম্ভীর্য রক্ষা করা প্রয়োজন সে-ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সচেতনতাই লক্ষ করা যায় না ওই কৈশোরক চপলতার কারণে। প্রথম দর্শনে স্বামীকে তার যে ভাবী শ্বশুর বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, বিয়ের পরেও সেটি তার কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে থাকে ওই কৈশোরক অনুভূতির কারণেই। ধর্মপালন কিংবা স্বামীর নির্দেশ পালন উভয় ক্ষেত্রেই তার মধ্যে যে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার অভাব তার মূলে রয়েছে এই বয়সোচিত অপরিপক্বতা। মাজার সম্পর্কে রহিমার মতো সে ভীতিবিহ্বল নয় কিংবা মাজারের পবিত্রতা সম্পর্কেও নয় সচেতন এবং এই একই কারণে মাজারে সংঘটিত জিকির অনুষ্ঠান দেখার জন্য তার ভিতরে কৌতূহল মেটাতে কোথায় তার অন্যায় ঘটে তা উপলব্ধির ক্ষমতাও তার হয় না। সুতরাং স্বামী মজিদ যখন এসবের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তার অনুচিত কর্ম সম্পর্কে তাকে সচেতন করে, তখন সেসবের কিছু তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না। সুতরাং তাকে শাসনের ব্যাপারে মজিদের সকল উদ্যোগই তার কাছে অত্যাচার কিংবা নিপীড়ন বলে মনে হয়। এবং এই পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের জন্য মজিদের মুখে যে সে থুথু নিক্ষেপ করে সেটাও তার মানসিক অপরিপক্বতারই ফল। এমনকি মাজারে যখন তাকে বন্দি করে রেখে আসে মজিদ তখন সেই অন্ধকারের নির্জনে ঝড়ের মধ্যে ছোট মেয়েটা ভয়ে মারা যেতে পারে বলে রহিমা যখন আতঙ্কে স্বামীর ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে তখনও জমিলাকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখা যায়। এরূপ আচরণের মূলেও সক্রিয় থাকে তার স্বল্প বয়সোচিত ছেলেমানুষি, অপরিপক্বতা। অর্থাৎ এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে একটি প্রাণময় সত্তার উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। শাস্ত্রীর ধর্মীয় আদেশ নির্দেশের প্রাবল্যে পুরো মহব্বতনগর গ্রামে যে প্রাণময়তা ছিল রুদ্ধ, জমিলা যেন সেখানে এক মুক্তির সুবাতাস। রূদ্ধতার নায়ক যে মজিদ, ঔপন্যাসিক সেই মজিদের গৃহেই এই প্রাণময় সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
একদিকে সে নারী অন্য দিকে সে বয়সে তরুণী-দুটিই তার প্রাণধর্মের এক প্রতীকী উদ্বাসন। এ উপন্যাসে মজিদের মধ্য দিয়ে যে ধর্মতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছে তার পেছনে পুরুষতন্ত্রও সক্রিয়। সুতরাং নির্জীব ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে সজীব প্রাণধর্মের জাগরণের ক্ষেত্রে এ নারীকে যথাযথভাবেই আশ্রয় করা হয়েছে। জমিলা হয়ে উঠেছে নারীধর্ম, হৃদয়ধর্ম বা সজীবতারই এক যোগ্য প্রতিনিধি।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ ও খালেক ব্যাপারীর পরিবার ছাড়া আরেকটি পরিবারের কাহিনি গুরুত্ব লাভ করেছে। সেটি তাহের-কাদের ও হাসুনির মায়ের পরিবার। এদের পিতামাতার কলহ এবং তাই নিয়ে মজিদের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে তাহের-কাদেরের পিতা চরিত্রটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। উপন্যাসে এটিই একমাত্র চরিত্র যে মজিদের আধ্যাত্মিক শক্তির ব্যাপারে অবিশ্বাস পোষণ করেছে, বিচার সভায় প্রদর্শন করেছে অনমনীয় দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব। তার নির্ভীক যুক্তিপূর্ণ ও উন্নত-শির অবস্থান নিশ্চিতভাবে ব্যতিক্রমধর্মী। সে মজিদের বিচারের রায় অনুযায়ী নিজ মেয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে ঠিকই কিন্তু তা মজিদের প্রতি শ্রদ্ধা বা আনুগত্যবশত নয়। মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই সে এ কাজ করেছে। তবে এর পরপরই তার নিরুদ্দেশ গমনের ঘটনায় এই চরিত্রের প্রবল ব্যক্তিত্বপরায়ণতা ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় ফুটে ওঠে। এই আচরণের মধ্য দিয়ে মজিদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদও ব্যক্ত হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনি অত্যন্ত সুসংহত ও সুবিন্যন্ত। কাহিনি-গ্রন্থনায় লেখক অসামান্য পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনির বিভিন্ন পর্যায়ে নাট্যিক সংবেদনা সৃষ্টিতে লেখক প্রদর্শন করেছেন অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা, ধর্মতন্ত্র ও ধর্মবোধের দ্বন্দ্ব, ধর্মতন্ত্র-আশ্রয়ী ব্যবসাবৃত্তি ও ব্যক্তির মূলীভূত হওয়ার প্রতারণাপূর্ণ প্রয়াস, অর্থনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোর সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির যোগ প্রভৃতি বিষয়কে লেখক এক স্বাতন্ত্রমণ্ডিত ভাষায় রূপায়ন করেছেন। এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র শেকড়হীন বৃক্ষপ্রতিম মজিদ ধর্মকে আশ্রয় করে মহব্বতনগরে প্রতিষ্ঠা-অর্জনে প্রয়াসী হলেও তার মধ্যে সর্বদাই কার্যকর থাকে অস্তিত্বের এক সূক্ষ্মতর সংকট। এরূপ সংকটের একটি মানবীয় দ্বন্দ্বময় রূপ সৃষ্টিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সার্থকতা বিস্ময়কর।
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Phasellus imperdiet, nulla et dictum interdum, nisi lorem egestas odio, vitae scelerisque enim ligula venenatis dolor. Maecenas nisl est, ultrices nec congue eget, auctor vitae massa. Fusce luctus vestibulum augue ut aliquet. Mauris ante ligula, facilisis sed ornare eu, lobortis in odio. Praesent convallis urna a lacus interdum ut hendrerit risus congue. Nunc sagittis dictum nisi, sed ullamcorper ipsum dignissim ac. In at libero sed nunc venenatis imperdiet sed ornare turpis. Donec vitae dui eget tellus gravida venenatis. Integer fringilla congue eros non fermentum. Sed dapibus