রচনা
রচনা : শ্রমের মর্যাদা
জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব
ভুমিকা : অনু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত, বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে শ্রম। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই পৃথিবীর সব কাজ- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎস- যা কিছু দৃশ্যমান সবই অর্জিত হয়েছে শ্রমের দ্বারা। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, “লাইসা লিল ইন্সানে ইল্লা মা সাত্তা।” অর্থাৎ, মানুষের জন্যে শ্রম ব্যতিরেকে কিছুই নেই। জ্ঞানীর জ্ঞান, নিজ্ঞানের অত্যাশ্চার্য আবিষ্কার, ধর্মসাধকের আত্মোপলব্ধি, ধনীর ধনৈশ্বর্য, যোদ্ধার যুদ্ধে জয়লাভ সবকিছুই শ্রমলব্ধ।
শ্রমের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা : “Man is the architect of his own fate.” –মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্যের নির্মাতা। আর এই ভাগ্যকে নির্মাণ করতে হয় নিরলস শ্রম দ্বারা। মানুষের জন্ম দৈবের অধীন, কিন্তু কর্ম মানুষের অধীন। যে মানুষ কর্মকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেছে, জীবন-সংগ্রামে তারই জয়। কর্মই সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিশ্রমই মানুষের যথার্থ শাণিত হাতিয়ার। সৌভাগ্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণের একমাত্র উপায় হচ্ছে শ্রম। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্যতা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। মানবজীবন অনন্ত কর্মমুখর। বহু প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এ জন্যে তাকে নিরন্তর কাজ করে যেতে হয়। তাই, জগৎ কর্মশালা আর জীবনমাত্রই পরিশ্রমের ক্ষেত্র।
Virgil বলেছেন,
তাই শ্রমেই সফলতা, শ্রমেই সুখ, শ্রমই জীবন। আমরা সবাই শ্রমসৈনিক।
শ্রমজীবীদের প্রতি সমাজের উপরতলার মানুষের অবহেলা ও অবজ্ঞা দেখে একালের কবি উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেন-
মানুষ মরণশীল প্রাণী কিন্তু কর্মের মাধ্যমেই সে অমর হতে পারে। আজকেরর মানুষের কর্মই আগামী দিনের মানুষকে নতুন কর্মে উজ্জীবিত করে, নতুন কল্যাণ নতুন অগ্রগতি সাধনে ব্রতী করে। তাই মানুষ কেবল জীবন যাপনেই বাঁচে না, শ্রমের শক্তিতেই বাঁচে। আর শ্রমই মানুষকে করে তোলে অমর। তাই প্রখ্যাত লেখক মাক্সিম গোর্কে বলেছেন-
শ্রমের প্রকারভেদ : শ্রমকে সাধারণত দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন :
(১) মানুসিক শ্রম
(২) শারীরিক শ্রম।
এই উভয় প্রকার শ্রমের গুরুত্বই অপরিসীম।
মানসিক শ্রম : মানসিক শ্রম ছাড়া মানসিক উন্নতি সম্ভব নয়। কথায় বলে- ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।’ শ্রমবিমুখ ব্যক্তির মনে কখনো সুচিন্তা ও সদ্ভাব উদয় হয় না। পক্ষান্তরে পরিশ্রমী ব্যক্তির মন ও মস্তিষ্ক সবসময় কু-চিন্তা থেকে দূরে থাকে। বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও শিল্পীর পরিশ্রম মূলত মানসিক। তবে তাঁদের এই মানসিক শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে গিয়ে তাঁরা কায়িক শ্রমও করে থাকেন।
শারীরিক শ্রম বা কায়িক শ্রম : জগতের সকল জীবকেই বেঁচে থাকার জন্যে কম-বেশি শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিতে হয়। মানসিক শ্রম একটা কাজের উদয় করে আর শারীরিক শ্রম বা সমাধা করে। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে শারীরিক শ্রমের নিমিত্তে হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েছেন। শারীরিক শ্রম আত্মসম্মানের পরিপন্থী নয় বরং সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান উপায়। চাষী, শ্রমিক, কুলি, মজুর- এরা দেশ ও জাতিকে রক্ষার মহান দায়িত্ব নিয়েই শারীরিক শ্রমে অবতীর্ণ হয়। তাই কবি নজরুল ইসলাম তাঁদের বন্দনা করেছেন-
ব্যাক্তিজীবনে ছাত্রজীবনে শ্রমের উপযোগিতা : শ্রম যে শুধু সমষ্টির জীবনকেই সন্দর ও মহিমাময় করে তা নয়, ব্যক্তিজীবনেও তার গুরুত্ব গভীর, ব্যপক। যে অলস ও শ্রমবিমুখ তার জীবনে নেমে আসে অসুন্দরের অভিশাপ। নানা ব্যর্থতার গ্লানিতে সে-জীবন পদে পদে অনাদৃত, লাঞ্ছিত। তার জীবনের স্বাভাবিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়। জীবনের সাফল্য-স্পন্দিত প্রাঙ্গণে তার নেই প্রবেশের ছাড়পত্র মানুষের স্নেহ-ভালোবাসার অঙ্গন থেকে ঘটে তার চিরনির্বাসন। থাকে শুধু অভিশপ্ত জীবনের সীমাহীন অন্তর্জ্বালা আর লাঞ্ছনা, শুধুই ‘প্রাণ ধারণের গ্লানি’। পক্ষান্তরে, পরিশ্রমী মানুষ দেহে ও মনে সুস্থ, সুন্দর। সার্থকতার ছন্দে সে-জীবন নিত্য উচ্ছলিত। শ্রমের ক্লান্তি তার জীবনে বিশ্রামের মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়।
আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা : দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের এক ধরণের অবজ্ঞা ঘৃণা রয়েছে। ফলে শিক্ষিত-সমাজের একটা বিরাট অংশ কায়িকশ্রম থেকে দূরে সরে আছে। চরম বেকারত্ব ও আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তারা শ্রমবিমুখ। আর এই শ্রমবিমুখতার কারণেই আমরা আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছি। তাই জীবনকে, দেশ ও জাতিকে সফল ও সার্থক করে গড়ে তোলার জন্যে শ্রম-বিমুখতা পরিহার করতে হবে।
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা : আমাদের মহানবী (স) পরিশ্রমের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি নিজেও শ্রমিকের সাথে বিভিন্ন কর্হবে।
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা : আমাদের মহানবী (স) পরিশ্রমের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি নিজেও শ্রমিকের সাথে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন। শ্রমিকদের দেহের ঘাম শুকাবার আগেই তিনি তার পরিশ্রমিক পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
শ্রমিক লাঞ্ছনা : সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ যারা, তারা করছে সম্মানের কাজ, গৌরবের কাজ। সমাজের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিজেদের কুক্ষিগত করে তারা তথাকথিত নিচুশ্রেণীর মানুষকে নিক্ষেপ করেছে অপমান, ঘৃণা বঞ্চনার তীব্র অন্ধকারে। অথচ সেই শ্রমিকেরা চিরকাল নদীর ঘাটে ঘাটে বীজ বুনেছে, পাকা ধান ফলিয়েছে। তারা ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ করে সোনার ফসল ফলিয়েছে-
অথচ তারা-ই পায়নি যথার্থ মানুষের সম্মান।
শ্রমশীল ব্যক্তির উদাহরণ : বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ও মনীষীগনের জীবনসাধনা ও সাফল্যের কারণ নিরলস পরিশ্রম। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী।
শ্রমবিমুখতা : শ্রমবিমুখতা ও অলসতা জীবনে বয়ে আনে নিদারুণ অভিশাপ। শ্রমহীন জীবনকে ব্যর্থতা এসে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলে।
এ কথা তর্কাতীতভাবে সত্য। যে ব্যক্তি শ্রমকে অবজ্ঞা করে, তার শ্রম সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। বিখ্যাত মনীষী কার্লাইল বলেছেন, ‘আমি মাত্র দুই প্রকৃতির লোককে সম্মান করি। প্রথমত ঐ কৃষক এবং দ্বিতীয়ত যিনি জ্ঞানধর্ম অনুশীলনে ব্যাপৃত আছেন’। সুতরাং একমাত্র নির্বোধেরাই শ্রমকে অবজ্ঞা করে।
উপসংহার: ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।’ শ্রমের গৌরব ঘোষণা আজ দিকে দিকে। একমাত্র শ্রমশক্তির মাধ্যমেই জীবনে অর্জিত হয় কাঙ্খিত সাফল্য, স্থিতি ও পরিপূর্ণতা। নিরলস শ্রমসাধনায় সাফল্য অর্জন করে জীবজগতের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করেছে। সুতরাং জীবনকে সুষ্ঠ স্বাভাবিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শ্রম ব্যতীত অন্য কোনো সহজ উপায় নেই। আর তাই শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ব্যক্তিগত তথা জাতিগতভবে প্রয়োজন। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল তাঁর ‘মানব-বন্দনায়’ সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সকল শ্রমশীল ব্যক্তিদের উদ্দেশে বন্দনা করেছেন-
.