শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১৮

মাসি পিসি বাংলা গদ্য


✿ গদ্য - মাসি পিসি

✿কবি পরিচিতি:
- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯এ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকনাম মানিক । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন।

প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তাপর জীবনের বাকি আটাশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক হিসেবে মানিক বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান। অল্প সময়েই তিনি সৃষ্টি করেছেন প্রায় চল্লিশটি উপন্যাস ও প্রায় তিনশ ছোটগল্প। সেই সঙ্গে লিখেছেন কিছু কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, ও ডায়েরি। বিজ্ঞানমনস্ক এই লেখক মানুষের জগৎ তথা অন্তর্জীবনের রূপকার হিসেবে সার্থকতা দেখিয়েছেন। একই সঙ্গে সমাজবাস্তবতার শিল্পি হিসেবেও সাক্ষর রেখেছেন। ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘চিহ্ন’, প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘প্রাগেতিহাসিক’, ‘সরিসৃপ’, ‘সমুদ্রের স্বদ’, ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’, ‘টিকটিকি’, ‘হলুদ পোড়া’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’,‘হারানের নাসজামাই’, ‘ছোটবকুল পুরের যাত্রী’ প্রভৃতি।

কলকাতায় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তেসরা ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

✿পাঠ-পরিচিতি:-
‘মাসিপিসি’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল ১৯৪৬)। পরে এটি সংকলিত হয় ‘পরিস্থিতি’ (অক্টোবর ১৯৪৬) নামক গল্পগ্রন্থে। বর্তমান পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশিত মানিক-রচনাবলি পঞ্চম খণ্ড থেকে।

স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার পিতৃমাতৃহীন এক তরুণীর করুন জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মাসি-পিসি’ গল্প। আহ্লাদি নামক ওই তরুণীর মাসি ও পিসি দুজনই বিধবা ও নিঃস্ব। তারা তাদের অস্তিত্বরক্ষার পাশাপাশি বিরূপ বিশ্ব থেকে আহ্লাদিকে রক্ষার জন্য যে বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করে সেটাই গল্পটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। অত্যvচারী স্বামী এবং লালসা-উন্মত্ত জোতদার, দারোগা ও গুণ্ডা-বদমাশদের আক্রমণ থেকে আহ্লাদিকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে অসহায় দুই বিধবার দায়িত্বশীল ও মানবিক জীবনযুদ্ধ খুবই প্রশংসনীয়। দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী স্মৃতি, জীবিকা নির্বাহের কঠিন সংগ্রাম, নারী হয়ে নৌকাচালনা ও সবজির ব্যবসায় পরিচালনা প্রভৃতি এ গল্পের বৈচিত্র্যময় দিক।

সৃজনশীল প্রশ্ন
উদ্দীপকটি পড়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
নিঃসন্তান ও বিধবা ফাতেমার আপন বলতে কেউ নেই। একদিন সকালে রাস্তায় একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখেন। স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। সব শুনে তিনি মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, মাতৃস্নেহে আশ্রয় দেন। স্বামীপক্ষ খবর পেয়ে তাকে নিয়ে যেতে চায়। মেয়েটি কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক নয়। বৃদ্ধা ফাতেমাও মেয়েটিকে যেতে দেননি। এতে তাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। মৃত্যুর আগে বৃদ্ধা মেয়েটিকে সমুদয় সম্পত্তি দান করে যান।

ক. ‘ছেলের মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়’—উক্তিটি কার?
খ. ‘যুদ্ধের আয়োজন করে তৈরি হয়ে থাকে মাসি-পিসি’—উক্তিটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকের মেয়েটি ‘মাসি-পিসি’ গল্পের আহ্লাদির সঙ্গে কিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করো।
ঘ. ‘মাসি-পিসি’ গল্পের মাসি-পিসি ও উদ্দীপকের বৃদ্ধা কি একসূত্রে গাঁথা? মতামত দাও।

উত্তর :

ক। ‘ছেলের মুখ দেখে পাষাণ নরম হয়’—উক্তিটি পিসির।


খ। ‘যুদ্ধের আয়োজন করে তৈরি হয়ে থাকে মাসি-পিসি’—উক্তিটি দ্বারা সমাজের কুচক্রীদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে দুই বিধবার দায়িত্বশীল ও মানবিক জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতিকে বোঝানো হয়েছে। আহ্লাদিকে অপহরণ করার হীন মতলবে জোতদার ও দারোগা বাবু কানাই চৌকিদারকে পাঠায় মাসি-পিসির বাড়িতে। তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। কিন্তু মাসি-পিসি তা বুঝতে পারে। তারা চিত্কার করে লোক জড়ো করে। অস্ত্র হাতে ধাওয়া করে দোষীদের। কিন্তু তার পরও শত্রুর অনিষ্ট বিষয়ে নিশ্চিত হয় না মাসি-পিসি। তাই বড় গামলাভর্তি জল ও কাঁথা আর কম্বল ভিজিয়ে রাখে। হাঁড়ি-পাতিল ভরে রাখে। আগুন দিলে তাতে নেভানো যাতে সহজ হয় এ জন্য এ প্রস্তুতি। আর হাতের কাছে রাখে ধারালো অস্ত্র।


গ। নির্যাতিতা ও অসহায়ত্বের প্রতিনিধি হিসেবে উদ্দীকের মেয়েটি ‘মাসি-পিসি’ গল্পের আহ্লাদির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসি-পিসি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আহ্লাদির। সে স্বামী-সংসারে নির্যাতিতা। স্বামীর ঘরে টিকতে না পেরে বিধবা মাসি-পিসির কাছে ঠাঁই নেয়। মাসি-পিসির যত্নের কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু আশপাশের কুচক্রীরা কুদৃষ্টি দিয়ে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। স্বামীর বাড়ি থেকে হুমকি আসে। জোতদার দারোগা বাবুর সহায়তায় চৌকিদার পাঠায়। বাবার সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ায় অনেকেই তাকে খরিদ করার পাঁয়তারা করে। উদ্দীপকের ষাটোর্ধ্ব ফাতেমা আশ্রয় দেন অসহায় মেয়েটিকে। মেয়েটি স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। বৃদ্ধা মাতৃস্নেহে তাকে লালন করতে থাকেন। আপন করে নেন। স্বামীর ঘর থেকে নিতে এলেও বৃদ্ধা যেতে দেননি মেয়েটিকে। মৃত্যুকালে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে যান এই মেয়েটিকে। আর এখানেই উদ্দীপকের মেয়েটি ‘মাসি-পিসি’ গল্পের আহ্লাদির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।


ঘ। ‘মাসি-পিসি’ গল্পের আহ্লাদি স্বামী-সংসারে নির্যাতিতা। অসহায় হয়ে সে মাসি-পিসির কাছে আসে। সেখানে যত্ন-আত্তির ত্রুটি ছিল না তার। কিন্তু আশপাশের দুর্বৃত্তদের চোখ পড়ে অসহায় মেয়েটির ওপর। মাসি-পিসি জীবন বাজি রেখে মেয়েটিকে রক্ষা করতে চান। মাসি-পিসি সারাক্ষণ চিন্তা করেন খাইয়ে-পরিয়ে যত্নে রাখতে হবে আহ্লাদিকে। শ্বশুরবাড়ির কবল থেকে বাঁচাতে হবে, এমনকি গাঁয়ের বজ্জাতদের নজর থেকে সামলে রাখতে হবে, কত দায়িত্ব তাদের, কত কাজ। উদ্দীপকের ফাতেমা বেগম বিধবা। সকালে হাঁটতে গিয়ে অসহায় একটি মেয়েকে ঘরে তুলে আনেন তিনি। মেয়েটি স্বামীর হাতে নির্যাতিতা। শ্বশুরবাড়ি থেকে নিতে এলেও ফাতেমা বেগম যেতে দেননি তাকে। অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয় তাকে। এমনকি মৃত্যুর আগে নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার করে যান মেয়েটিকে। উদ্দীপকের ফাতেমা বেগম বিধবা। কিন্তু মানবিকবোধে উজ্জীবিত এক মহান দায়িত্ববান নারী। অন্যদিকে ‘মাসি-পিসি’ গল্পের মাসি ও পিসি আহ্লাদির প্রেক্ষিতে দায়িত্ব-কর্তব্যের এক বিরল দৃষ্টান্ত। সার্বিক আলোচনায় বলা যায়, ‘মাসি-পিসি’ গল্পের মাসি ও পিসি এবং উদ্দীপকের বৃদ্ধা একসূত্রে গাঁথা।

৩। আব্দুল লতিফের কিশোরী মেয়েটা এবার বাপের বাড়ি এসে কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি যেতে চাচ্ছে না। যৌতুকের টাকা দিতে না পেরে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির বৈবাহিক অত্যাচার কিছুইতেই সহ্য করতে পারছে না। আব্দুল লতিফ এ ব্যাপারে মেয়ের ওপর জোর খাটানোর চেষ্টা করে না। বরং প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং যৌতুক ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করে।

ক) ‘মাসি-পিসি’ গল্পের জীবনভাষ্য কী? ১
খ) জগু কেন আহ্লাদির উপর নির্মম নির্যাতন চালায়? ২
গ) উদ্দীপকের আব্দুল লতিফ ‘মাসি-পিসি’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে? বর্ণনা কর। ৩
ঘ) ‘উদ্দীপক ও ‘মাসি-পিসি’ গল্পের চেতনা অভিন্ন’-মন্তব্য যাচাই কর। ৪


বহুনির্বাচনী প্রশ্নের জন্য ক্লিক করুন >>

✿গুরুত্বপূর্ণ...

। ১. শেষবেলায় খালে থাকে - পুরো ভাটা
২. খালের ধারে লাগানো সালতিটি কোথায় ছিলো - কংক্রিটেরর পুলের উপর
৩. সালতি থেকে পাড়ে তোলা হচ্ছে - খড়
৪. মাঝখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে- আহ্লাদি
৫. অল্প বয়সী বৌটির গায়ে ছিলো - নকশা পাড়ের সস্তা সাদা শাড়ি
৬. আঁট সাঁট থমথমে গড়ন,গোলগাল মুখ- আহ্লাদির
৭. মাসি-পিসি ফিরছে কৈলেশ উক্তিটি- বুড়ো লোকটির(রহমানের)
৮. "বেলা আর নেই কৈলেশ " উক্তিটি - মাসি বলে বিরক্তির সঙ্গে
৯. "অনেকটা পথ যেতে হবে কৈলেশ " উক্তিটি - পিসির
১০. "বেলা বেশি নেই কৈলেশ " উক্তিটি - পিসির
১১. কৈলেশের সাথে দেখা হয়েছিল - জগুর
১২. জগু হল- আহ্লাদির স্বামী
১৩. উড়ে ত্রসে জুড়ে বসেছে - মাসি
১৪. পিসির অহংকার আর খোঁচাই সবচেয়ে অসহ্য লাগত- মাসির
১৫. আহ্লাদিকে বাঁচাতে হবে- শ্বশুরঘরের কবল থেকে
১৬. আহ্লাদিকে সামলে রাখতে হবে - গাঁয়ের বজ্জাতদের নজর থেকে
১৭. জগুর বৌ নেবার আগ্রহ- খুবই স্পষ্ট
১৮. "ডারসনি আহ্লাদি " উক্তিটি - মাসির
১৯. "ডরাসনি,ডর কিসের "? উক্তিটি- পিসির
২০. "কাছারি বাড়ি যেতে হবে ত্রকবার " উক্তিটি- কানাইয়ের
২১. গাঁয়ের গুণ্ডা হলো- সাধু বৈদ্য ওসমানেরা
২২. ফেটি-বাধা বাবরি চুল কার- বৈদ্যের
২৩. কাঁঠাল গাছের ছায়ায় কত জন ঘুপটি মেরে ছিলো- তিন - চারজন।

✿গুরুত্বপূর্ণ....

১. জেলের ভিতর অনশন ধর্মঘট করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল - শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন
২. জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলো - আমীর হোসেন সাহেব।
৩. রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার ছিল- মোখলেসুর রহমান সাহেব।
৪. শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো- ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা
৫. লেখকের মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে হাজির হল- জমাদার সাহেব
৬. নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে - ১১ টায়
৭. লেখকদেরর জন্য আনা হয়েছে - বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি
৮. বন্ধ ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে লেখকদের সাথে বসল - দুইজন
৯. ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে ছিলো - একজন আর্মড পুলিশ
১০. শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথমে নেয়া হয় - নারায়ণগঞ্জ থানায়
১১. পরবর্তীতে নেয়া হয় - ফরিদপুর জেলে
১২. লেখকরা স্টেশনে আসল - রাত ১১ টায়
১৩. জাহাজ ছাড়ল - রাত ১ টায়
১৪. জাহাজ গোয়ালন্দ ঘাটে পৌছল - রাতে
১৫. তারা পেট পরিষ্কার করার জন্য - ঔষধ খেল
১৬. মুহিউদ্দিন ভুগছে - প্লুরিসিস রোগে
১৭. লেখকদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে লাগল- ৪ দিন পর
১৮. লেখকের একটা ব্যারাম ছিলো - নাকে
১৯. লেখকের নাকে ঘা হয়ে গেছে - দু-তিন দিন পর
২০. বার বার অনশন করতে নিষেধ করছিলেন - সিভিল সার্জন সাহেব ।

✿গদ্য - বায়ান্নর দিনগুলো

✿লেখক পরিচিতি
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির জনক। তাঁর জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়।তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়ারা খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি ও দেশব্রতে যুক্ত হন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভগে অধ্যায়ন করেন। ভাষা-আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি বহু বার কারাবরণ করেছেন।বাঙ্গালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে এক সর্বাত্বক গড়ে তুলে তিনি সমস্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে অসহযোগের ডাক দেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করার জন্য ১৯৭১-এর ২৫এ মার্চ মধ্যরাতের পরে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙ্গালির এই অবিসংবাদিত নেতাকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে অর্থাৎ ২৬এ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশর স্বধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার মহান দায়িত্বে ব্রতী হন। বাঙ্গালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালি যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।

✿পাঠ-পরিচিতি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২) গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সহধর্মিণীর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দি থাকা অবস্থায় এই আত্মজীবনী লেখা আরম্ভ করেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকায় জীবনী লেখা বন্ধ হয়ে যায়। জীবনীটিতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। যৌবনের অধিকাংশ সময় কারা প্রকোষ্ঠের নির্জনে কাটলেও জনগণ-অন্তপ্রাণ এ মানুষটি ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, গভীর উপলব্ধি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ তিনি এ গ্রন্থে সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন।

‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন ও জেল থেকে মুক্তিলাভের স্মৃতি বিবৃত হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন ও বিনাবিচারে বৎসরের পর বৎসর রাজবন্দিদের কারাগারে আটক রাখার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে লেখক অনশন ধর্মঘট করেন। স্মৃতিচারণে ব্যক্ত হয়েছে অনশনকালে জেল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও আচরণ, নেতাকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ ও তাদের কাছে বার্তা পৌঁছানোর নানা কৌশল ইত্যাদি। স্মৃতিচারণে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ছাত্রজনতার মিছিলে গুলির খবর। সেই সঙ্গে অনশনরত অবস্থায় মৃত্যু অত্যাসন্ন জেনে পিতামাতা-স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাবনা এবং অবশেষে মুক্তি পেয়ে স্বজনদের কাছে ফিরে আসার স্মৃতি হৃদয়স্পর্শী বিবরণও পরিস্ফুট হয়েছে সংকলিত অংশে।

✿গুরুত্বপূর্ণ....

১. শেখ মুজিবুর রহমান ছোট ছোট চিঠি লিখল - ৪ টা
২. শোভাযাত্রা করে জেলগেটে ত্রসেছিল - ২২ তারিখে
৩. অপরিণামদর্শিতার কাজ করল - মুসলিম লীগ সরকার
৪. দুনিয়ার কোথাও গুলি করে হত্যা করা হয় নাই - মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য
৫. মানুষের যখন পতন আসে তখন ভুল হতে থাকে - পদে পদে
৬. খানসাহেব ওসমান আলীর বাড়ি - নারায়ণগঞ্জ
৭. ত্রক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে - ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে
৮. "তোমার অর্ডার এসেছে " উক্তিটি - মহিউদ্দিনের
৯. ডাবের পানি আনিয়েছেন - ডাক্তার সাহেব
১০. মহিউদ্দিন লেখকের অনশন ভাঙ্গিয়ে দিলেন- দুই চামচ ডাবের পানি দিয়ে।
১১. ফরিদপুর জেল থেকে লেখক বাড়ি পৌঁছলেন - ৫ দিন পর
১২. লেখকদের বড় নৌকায় মিল্লা ছিল - ৩ জন
১৩. কথার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে- রেণুর
১৪. আমরা আজ স্বাধীন হয়েছি - ২০০ বছর পর
১৫. প্লুরিসিস - বক্ষব্যাধি
১৬. প্রকোষ্ঠ - ঘর বা কুঠরি ।

.

বাংলা ১ম পত্র গদ্য


✿ গদ্য - চাষার দুক্ষু ।

✿গুরুত্বপূর্ণ

১. কখন ভারতবাসী অসভ্য বর্বর ছিলো- ১৫০ বছর পূর্বে।
২. কাকে সমাজের মেরুদণ্ড বলা হয়েছে - চাষাকে
৩. জুট মিলের কর্মচারীর মাসিক বেতন কত টাকা - ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
৪. 'নবাবি হালে থাকে, নবাবি চাল চালে ' কারা - জুট মিলের কর্মচারীরা।
৫. আমাদের বঙ্গভূমি কেমন- সুজলা, সুফলা, শস্য - শ্যামল।
৬. "ধান্য তার বসুন্ধরা যার " উক্তিটি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
৭. কোন মহাযুদ্ধ সমস্ত পৃথিবীটাকে সর্বস্বান্ত করেছে - ইউরোপের যুদ্ধ।
৮. বাল্যকালে লেখিকা কী শুনিতেন? - টাকায় ৮ সের সরিষা।
৯. কার মাথায় বেশ ঘন ও লম্বা চুল ছিলো- কৃষক কন্যা জমিরনের।
১০. জমিরনের মাথায় কতটুকু তেল লাগত? - আধ পোয়াটাক।
১১. কত পয়সায় এক সের তৈল পাওয়া যেত? - দুই গণ্ডা পয়সায়।
১২. কোন মাছ পরম উপাদেয় ব্যঞ্জন বলে পরিগণিত হত? - শুঁটকি মাছ।
১৩. কীসের বিনিময়ে কৃষক পত্নী কন্যা বিত্রূয় করত? - দুই সের খেসারির।
১৪. আসাম ও রংপুর জেলার রেশমকে স্থানীয় ভাবে কি বলে- ত্রন্ডি
১৫. কি নামক আর একটা ভূত তাহাদের স্কন্ধে চাপিয়া আছে? - অনুকরণপ্রিয়তা
১৬. কারা পাল্কি নিয়ে ট্রামে যাতায়াত করলে সভ্যতার চুড়ান্ত হবে? - শিবিকাবাহকগণ (পালকিবাহকগণ)
১৭. কীসের সঙ্গে সঙ্গে দেশি শিল্পসমূহ ত্রূমশ বিলুপ্ত হইয়াছে? - সভ্যতা বিস্তারের
১৮. পল্লিগ্রামের দুর্গতির প্রতি কাদের দৃষ্টি পড়িয়াছে? - দেশবন্ধু নেতৃবৃন্দেরর ।

✿গদ্য - আহ্বান

✿গুরুত্বপূর্ণ

১. লেখকের বাবার পুরাতন বন্ধুর নাম? - চক্কোত্তি মশায়
২."বাড়িঘর করবে না? " উক্তিটি - চক্কোত্তি মশায়
৩. বড় আম বাগানের মধ্য দিয়ে বাজারে যাচ্ছে - লেখক
৪. বুড়ির স্বামীরর নাম? - জমির করাতি
৫. বুড়ির স্বামী কাজ করতেন- করাতের
৬. বুড়ির আছে এক - নাত জামাই
৭. লেখক থাকে - এক ঙ্গাতি খুড়োর বাড়ি
৮. বুড়ি আপন মনে খুব খানিকটা বকে গেল- কাঠাঁলতলায় বসে
৯. পরদিন লেখক চলে গেল- কলকাতা
১০. লেখক তার নতুন তৈরি খড়ের ঘরখানাতে ত্রসে উঠল- জ্যৈষ্ঠ মাসে,গরমের ছুটিতে
১১. লেখকের মা-পিসি মারা গেছে- বাল্যকালে
১২. লেখক খায় - খুড়ো মশায়ের বাড়ি
১৩. লেখককে দুধ দেয়- ঘুঁটি গোয়ালিনী
১৪. বুড়ি লেখককে সম্বোধন করল - গোপাল বলে
১৫. সে কি! দুধ পেলে কোথায় ত্রতো সকালে - উক্তিটি লেখকের
১৬. বুড়িকে মা বলে ডাকে- হাজরা ব্যাটার বউ
১৭. "স্নেহের দান-ত্রমন করা ঠিক হয়নি "উক্তিটি - লেখকের
১৮. লেখক পুনরায় গ্রামে আসল- পাঁচ ছয় মাস পর, আশ্বিস মাসের শেষে
১৯. বুড়ি শুয়ে আছে- মাদুরের উপর
২০. বুড়ির মাথার বালিশ টা ছিলো-মলিন
২১. লেখক শরতের ছুটিতে গ্রামে ঢুকতেই দেখা হল- পরশু সর্দারের বউ/ দিগম্বরীর সাথে
২২. "ত্তমা আজই তুমি ত্রলে? " উত্তিটি- দিগম্বরীর
২৩. বুড়ি কোন ঝতুতে মারা,যায় -শরত
২৪. লেখক যাদের পাশে গিয়ে বসল তারা হল- আবদুল,শুকুর মিয়াঁ, নসর
২৫. আবেদালির ছেলের নাম- গণি
২৬. কবর খুঁড়ছে- দুই জন জোয়ান ছেলে
২৭. "দ্যাত্ত বাবা,তুমি দ্যাত্ত "উক্তিটা- শুকুর মিয়াঁর

✿গদ্য- আমার পথ ।

✿গুরুত্বপূর্ণ
১. কুর্নিশ - অভিবাদন
২. মেকি - মিথ্যা
৩. লেখকের পথ দেখাবে - লেখকেরর সত্য
৪. মানুষের মনএ আপনা আপনি বড় একটা জোর আসে কখন- নিজেকে চিনলে
৫. নিজেকে চিনলে মানুষ আপন সত্য ছাড়া আর কাইকে- কুর্নিশ করে না
৬. অনেক সময় খুব বেশি বিনয় দেখাতে গিয়ে অস্বীকার করা হয়- নিজের সত্যকে
৭. "ত্ত রকম বিনয়ের চেয়ে অহংকারেরর পৌরুষ অনেক-অনেক ভালো " উক্তিটি - লেখকের
৮. স্পষ্ট কথা বলায় কী থাকে - অবিনয়
৯. কী আমাদের নিষ্ত্রিয় করে ফেলল- পরাবলম্বন
১০. সবচেয়ে বড় দাসত্ব হল - পরাবলম্বন
১১. আত্মনির্ভরতা আসে কখন?- আত্মাকে চিনলে।
১২. শিখাকে নিভাতে পারবে- মিথ্যার জল।
১৩. সবচেয়ে বড় ধর্ম- মানুষ ধর্ম
১৪. অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না- যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে।
১৫. লেখক পথে বের হলেন- আগুনের ঝান্ডা ঝুলিয়ে।
১৬. সত্য প্রকাশে লেখক- নির্ভীক অসংকোচ।
১৭. কবির প্রাণ প্রাচুর্যের উংস বিন্দু - সত্যের উপলব্ধি।
১৮. ঐক্যের মূল শক্তি হলো- সম্প্রীতি।
১৯. লেখকে বাল্য নাম- দুখু মিয়া(ব্যাঙাচি)
২০. তার ছদ্মনাম- ধূমকেতু।

✿গদ্য - জীবন ও বৃক্ষ

✿গুরুত্বপূর্ণ
১. স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধি, জবরদস্তিপ্রিয় মানুষের দেবতা - অহংকার
২. জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয় - বৃক্ষের দিকে তাকালে
৩. রবীন্দ্রনাথেরর মনে মমনুষ্যত্বেরর বেদনা উপলব্ধি হয়- নদীর গতিতে
৪. তপোবন প্রেমিক কে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫. গোপন ও নিরব সাধনা অভিব্যক্ত হয় - বৃক্ষে
৬. দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে কে - বৃক্ষ
৭. "ত্রই তো সাধনার সার্থকতা " উক্তিটি - মোতাহের হোসেন চৌধুরীর
৮. সাধনার ব্যাপারে কি বড় জিনিস - প্রাপ্তি
৯. রবীন্দ্রনাথ অন্তরের সৃষ্টিকর্ম উপলব্ধি করেছেন - বৃক্ষের পানে তাকিয়ে
১০. বৃক্ষ আমাদের স্বার্থকতার গান শোনায় - নীরব ভাষায়
১১. প্রকৃতির ধর্ম কীসের মত- মানুষের ধর্মের মত
১২. তরুলতা ও জীব জন্তুর বৃদ্ধির উপর কাদের হাত নেই - মানুষের
১৩. মানুষের বৃদ্ধির উপর হাত রয়েছে - প্রকৃতির
১৪. মানুষের বৃদ্ধি কেমন- দৈহিক ও আত্মিক
১৫. মানুষের শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু - সাধনা
১৬. শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না - বস্তু জিঙ্গাসা তথা বিঙ্গান
১৭. জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয় - সাহিত্য শিল্পকলার দ্বারা
১৮. বৃদ্ধির ইশারা ও প্রশান্তির ইঙ্গিত কোথায় - বৃক্ষে
১৯. বৃক্ষ জীবনের গুরুভার বহন করে - অতি শান্ত ও সহিষ্ণুতায় ।

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮

ভাষণ রচনা ১


নবাগত ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ
১৭ মে, ২০১৫ ইং

মো. সুজাউদ দৌলা, প্রভাষক

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা

প্রশ্ন :তোমার কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে নবাগত ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ রচনা কর।

মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবকবৃন্দ এবং প্রীতিভাজন নবাগত ও সতীর্থ শিক্ষার্থী ভাইবোন— সবার প্রতি রইল আমার সালাম ও শুভেচ্ছা।
আমাদের এ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ নতুন প্রাণের স্পর্শে স্পন্দিত ও আনন্দ হিল্লোলে মুখরিত। নবাগত শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তোমরা এসেছ আমাদের কলেজের আঙিনায়, ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত জ্ঞানের আলোয়, উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক ক্ষেত্রে। তোমাদের এ আগমন শুভ হোক এ কামনা করি। তোমাদের সবার প্রতি রইল আমার আন্তরিক উষ্ণ অভিনন্দন ও গোলাপি শুভেচ্ছা।

নবাগত ভাই ও বোনেরা,

তোমরা জেনে খুশি হবে যে এই অঞ্চলের মধ্যে আমাদের এ প্রতিষ্ঠানটি নানা দিক থেকে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের অধিকারী। এক মহান ব্রত ধারণ করে আছে এ পবিত্র বিদ্যাঙ্গণ। যার স্লোগান হচ্ছে— ‘শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও।’ আজ থেকে তোমাদের জন্য এটাই হোক জীবনের মূলমন্ত্র। আলোকিত জীবনের জন্য তোমাদের সে অভিযাত্রা শুভ হোক, সুন্দর হোক।

নবাগত বন্ধুরা,

জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্বের সফল সমাপ্তির পর তোমরা আজ সম্পূর্ণ নতুন এবং মুক্ত জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করেছ। এখানে রয়েছে জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত অবকাশ এবং স্বাধীন চিন্তা বিকাশের অপূর্ব সুযোগ। নিরন্তর সাধনা ও পঠন-পাঠনের মাধ্যমে বিকশিত হোক তোমাদের মেধা ও মননশীলতা— এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

বন্ধুরা,

তোমরা জেনে খুুশি হবে যে আমাদের এ কলেজ থেকেই অতীতে পড়ালেখা করে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত হিসেবে দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন অনেকে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীই পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন সমাজে। তোমরাও তাদের মতোই দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।

নবীন বন্ধুরা,

আমাদের এ শিক্ষালয়ের দীর্ঘদিনের এক সুমহান ঐতিহ্য ও খ্যাতি রয়েছে দেশব্যাপী। এখানকার শিক্ষা-শৃঙ্খলা, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক, পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় ফলাফল সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রতিবছরই। আজ তোমরা যারা নতুন প্রাণশক্তি ও অমিত সম্ভাবনা নিয়ে এখানে এসেছ, তোমাদের সাদরে বরণ করে নিয়ে তোমাদেরকেও ঐতিহ্য রক্ষার সুমহান দায়িত্বে অংশীদার করছি। আশা করি, এ প্রতিষ্ঠানের গৌরব বৃদ্ধিতে তোমরাও প্রাণপণ চেষ্টা করবে।

বন্ধুরা,

এ প্রতিষ্ঠানে তোমাদের শিক্ষাজীবন সফল-সার্থক ও গৌরবময় হোক। এখানকার শিক্ষা নিয়ে তোমরা দেশ-জাতি ও বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিয়োজিত হও। যৌবনের আলোয় আলোকিত হোক তোমাদের ভুবন— এই প্রত্যাশায় শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ, সবার জন্য শুভকামনা।


প্রশ্ন: ‘আলোকিত মানুষ চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধান অতিথির একটি ভাষণ রচনা কর।

মাননীয় সভাপতি ও বরেণ্য অতিথিবৃন্দ। আজকের এই মহতী ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মানিত করার জন্য আমি আয়োজকদের জানাই কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে উপস্থিত সকলকে জানাই আমার আন্তরিক মোবারকবাদ।

বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, মুক্তবুদ্ধিচর্চার অভাব, স্বশিক্ষিত মানুষের অভাবের কারণে জাতি যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে, সেই মুহূর্তে দেশকে বাঁচাতে ও উন্নতি করতে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ায় আমি আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

সুধিবৃন্দ,
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘Education is the backbone of a nation’ অর্থাত্ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি শিক্ষিত নয়, সেই জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে বাধাগ্রস্ত হয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত্। তারা যদি অনগ্রসর থাকে তাহলে জাতি তার গতি হারিয়ে ফেলবে। তাই জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে হলে সেই জাতির প্রত্যেক ব্যক্তিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত এবং স্বশিক্ষিত হতে হবে।

প্রিয় শিক্ষা অনুরাগী

আমাদের দেশে ৫ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কিন্তু এ শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ না ঘটায় জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে তাল মেলানো সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ আবুল ফজল বলেছেন— ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতির শিক্ষিত জনশক্তি তৈরির কারখানা আর রাষ্ট্র ও সমাজদেহের সব চাহিদার সরবরাহ কেন্দ্র। দেশের সার্বিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রকে সুসংহতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করাই আলোকিত মানুষের প্রধান কাজ। আলোকিত মানুষ দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, শ্রমের মর্যাদা এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে দেশকে উন্নতির পথ দেখাতে পারে।

সুধি,

আলোকিত মানুষ গড়ার কাজটি খুব সহজ নয়। ঠিক এ মুহূর্তে একবার ভেবে দেখুন আলোকিত মানুষের অভাবে আমরা আজ কত নিচে আছি। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যথার্থ শিক্ষা নয়। এর সাথে স্বশিক্ষায় জনগণকে শিক্ষিত হতে হবে। আর আজকের এই প্রচেষ্টা শুধু একজনকে করলে অথবা এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলে চলবে না, এর জন্য সরকার ও জনগণ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে এক সাথে উচ্চারণ করতে হবে— চলো যাই পড়তে যাই

আলোকিত মানুষ চাই

সবার সুস্থ, সুন্দর জীবন কামনা করে, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ।

বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮

ভাষণ রচনা


Fox প্রশ্ন : ‘জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা’ সম্পর্কিত একটি ভাষণ তৈরি করো।

উত্তর : সম্মানিত সভাপতি, বরেণ্য প্রধান অতিথি, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, সুধী অভিভাবকবৃন্দ এবং সমবেত ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা- আস্সালামু আলাইকুম। আদর্শ ছাত্র বলতে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাতে একজন ছাত্রের মধ্যে মানুষের সামগ্রিক মহৎ গুণাবলিই প্রতিফলিত হয়। একজন আদর্শ ছাত্রের যে গুণাবলি দরকার সেগুলো হলো- সততা, আদর্শবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠা, উদ্যম, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ইত্যাদি। যেকোনো জাতির সেরা সম্পদ তরুণসমাজ তথা ছাত্রসমাজ। একটি জাতির সমৃদ্ধি, সম্মান আর মর্যাদার সঙ্গে আজকের ছাত্রসমাজের ভূমিকা সম্পৃক্ত। কারণ তারাই একসময় জাতির হাল ধরবে। তাদের কৃতকর্মের সফলতার ওপরই নির্ভর করবে জাতির ভবিষ্যৎ। বস্তুত একটি দেশ গঠনে যেকোনো দেশের ছাত্রসমাজ যুগোপযোগী ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বের যেকোনো দেশে ছাত্রসমাজ তাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকেই তাদের দেশ গঠনের কার্যক্রম নির্ধারণ করে। দেশের গঠনমূলক কাজে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজ, দেশ ও জাতির সমস্যাগুলো দূর করা গেলেই দেশের উন্নতি হবে। আর এই সমস্যাগুলো দূরীকরণে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দেশপ্রেম। ছাত্রসমাজ যদি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হতে পারে এবং তা দেশের সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে, তাহলেই জাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে। তখন সবাই মিলে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশের মূল সমস্যাগুলোর অন্যতম নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। ছাত্ররা যদি ঘুষ-দুর্নীতিসহ সব ধরনের নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেরাও সততার অনুশীলন করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হতে পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ। ছাত্রসমাজ যদি নিজেরাই আত্মকর্মসংস্থানের উপায় বের করতে পারে, তাহলে দেশে বেকারত্ব দূর হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।


প্রশ্ন:- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পছন্দের পোস্ট করতে আপনাকে লগইন করতে হবে।

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এ দিনে বাঙলির অবিসংবাধিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসের সেরা ১০ ভাষণের মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিরবঞ্চিত বাঙালিকে পাকিস্তানী শাসক-শোকদের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার যে ডাক দিয়েছিলেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে সামিল হয়েছিল মুক্তিরসংগ্রামে। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত ও ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের তিনি নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিরবারতা। সে দিনের সে ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমেই বর্বর সামরিক শক্তির মুখোমুখি হয়ে নতুন বাংলাদেশকে আগামীর পথে অগ্রসর হওয়ার শক্তি যুগিয়েছিলেন। তাই এ ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসের ম্যাগনাকাটার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন; সেই ভাষণটি পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসাবে বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। সংগত কারণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম ও ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য আরো বিশ্লেষেণের প্রয়োজন মনে করেই এ নিয়ে আজকের দিনে আমার এ আলোচনার সূত্রপাত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে অনেক লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও গবেষক অনেক আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। তারপরও এ ভাষণটি আরো বেশি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমি বঙ্গবন্ধুকে যতটুকু পড়েছি এবং পড়ার মাধ্যমে জেনেছি, সে হিসেবে এ ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে আরও বিশ্লেষণের দরকার; তাহলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব বিশেষত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও অধিক জানতে পারবে মানুষ। এখানে একটি কথা বলে রাখি, আমার মতো একজন নগন্য মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহীরূহের এমন একটি ঐতিহাসিক ভাষণের বিশ্লেষণ করতে যাওয়া শুধু সাহস নয় দুঃসাহসের কাজ। যদিও আমি “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ও জীবনধারা” নামক প্রায় সাত শত পৃষ্ঠার একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছি এবং সে বইটি ২০১৩ সালে অমর একুশের গ্রন্থমেলায় ‘জনতা পাবলিকেশনস’ থেকে প্রকাশিত এবং বিক্রির তালিকায় মোটামুটি ভাল অবস্থানে; তবু সবার প্রতি বিনয় মিনতি জানিয়ে বলছি এ আলোচনায় যাবতীয় ভূলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। যাক ভূমিকা না বাড়িয়ে আলোচনার গভীরে যাওয়া যাক-

জাতির জনক বঙ্গবন্থু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ট্রানিং পয়েন্ট। এই দিন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় যোগদানের জন্য দেশের বিভিন্নস্থান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ জলোচ্ছ্বাসের গর্জনে বাস, লঞ্চ, ষ্টিমার, নৌকা ও পায়ে হেটে বিপুল বিক্রমে রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বাঁধভাঙা মানুষের স্রোতে দুপুর হ’তে না হ’তেই ভরে ওঠে রেসকোর্সের ময়দান। বাতাসে ওড়ছে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সূর্যের পতাকা। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন আর সাথে সাথে দুলে উঠছে বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতীক লক্ষ লক্ষ বাঁশের লাঠি। মঞ্চ থেকে মাঝে মাঝেই শ্লোগান তুলছেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ‘জয় বাংলা’। ‘আপোষ না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম।’ ‘আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলদেশ স্বাধীন কর।’ ‘ঘরে ঘরে দুর্ঘ গড়-বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

জনসভার কাজ শুরু হ’তে তখনো অনেক সময় বাকি। কিন্তু রেসকোর্স বৃহত্তর পরিসর ময়দান পেরিয়ে জনস্রোত ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে কয়েক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ধর্মঘট শুরু করায় বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেতার কতৃপক্ষ রেসকোর্স থেকে সরাসরি সম্প্রচারের পূর্ব ঘোষণা দিয়ে পরে তা বাতিল করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হবে’এ ঘোষণার পর সারা বাংলার শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমার ভালোবাসি’ পরিবেশনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার মুহুর্তে আকস্মিকভাবেই ঢাকা বেতারে তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের কর্মীরা কাজ করতে অস্বীকার করলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

মুহূর্মুহূ গর্জনে ফেটে পড়েছে জনসমুদ্রের উত্তাল কন্ঠ। স্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লক্ষ কন্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লক্ষ কন্ঠের বজ্র শপথ। হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালির সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক বাঁশের লাঠি মুহর্মুহূ শ্লোাগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকশের দিকে। এই হলো রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন ৩টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ফাল্গুনের সূর্য ঠিক মাথার উপর ওঠার আগে থেকেই এই শ্লোগান চলছে। মঞ্চে মাইকে শ্লে¬াগান দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। স্লোগান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবদুর রাজ্জাক। লক্ষ কন্ঠে ফিরে আসছে স্লোগানের জওয়াব বজ্র হুঙ্কারে। স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে নেতৃবৃন্দ দিচ্ছেন টুকরো টুকরো বক্তৃতা। আর আকাশ-বাস কাঁপিয়ে ধ্বণিত হতে থাকে আগুনঝরা স্লোগান: বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার দেশ আমর দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ। শেখ মুজিবের পথ ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর। এরপরই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান। লক্ষ জনতার শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত তখন ঢাকার আকাশ-বাতাস। সে গগনবিদারী শ্লোগান চলা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন।

সে সময়ের আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সংগ্রাম কোন্ রূপ গ্রহণ করবে, তা কি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি বাঙালির মুক্তি আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, সে বিষয়টা নির্ভর করেছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিক-নির্দেশনার ওপর। তাই এ ভাষণ নিয়ে বাঙালি তথা আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যে কৌতুহল ও ভাবনার শেষ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর ভাষণের প্রতিটি বাক্য কবিতার পঙক্তিতে ভারসাম্যের ওজনে সর্বস্তরের মানুষের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই ভাষণের পর পরই ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার বস্নাডের লিখেছেন, “রোববার ৭ মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কি বলেন নি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।” আর্চার বস্নাড ঢাকায় অবস্থান করে পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মর্মার্থ ও তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গিবেষক মফিদুল হক বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণে প্রতিরোধ আন্দোলনের এই লোকায়ত রূপ মেলে ধরবার পাশাপাশি প্রত্যাঘাতের ডাক এমন এক লোকভাষায় ব্যক্ত করলেন বঙ্গবন্ধু যে তিনি উন্নীত হলেন অনন্য লোকনায়কের ভূমিকায়, যার তুলনীয় নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কাফেলায় বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার লোকঐতিহ্য ও জীবনধারার গভীর থেকে উঠে আসা ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃভূমিকায়। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যে কতটা সার্থক হয়ে উঠেছিলেন তার পরিস্ফূটন ঘটেছিল সঙ্কটময় মার্চ মাসে তাঁর অবস্থান ও ভূমিকা এবং ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। তিনি বক্তব্যে যেমন গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী, তেমনি আন্দোলনের স্বাদেশিক রীতির নব-রূপায়ন ও প্রসার ঘটালেন সার্বিক ও সক্রিয় অসহযোগের ডাক দিয়ে, যে অসহযোগে সামিল ছিল ব্যাপক জনতা এবং সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অসহযোগ আন্দোলন ও ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন উপচে পড়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিক-আধাসামরিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল বাঙালি সদস্যের ওপর এবং এর প্রতিফল জাতি লাভ করলো মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকেই। বক্তৃতার রূপ হিসেবেও প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষণের কাঠামো সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে বঙ্গবন্ধু এমন এক সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেন যা দেশের মাটির গভীরে শেকড় জারিত করা ও গণ-সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া অনন্য নেতার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর উন্নীত হয়েছিল ওরাকলের পর্যায়ে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা এবং এই অমোঘ বাণী দেশবাসীর অন্তরে যে অনুরণন তৈরি করেছিল সেই শক্তিতে অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হয়েছিলেন তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাতারে সামিল আরেক অনন্য নেতায়।’

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মুক্তির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে চির বঞ্চিত বাঙালির সংগ্রামের গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে আখ্যায়ীত করে বলেছিলেন,‘ “আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না।” তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ “আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।” গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের প্রত্যয় ব্যক্ত করেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন সম্ভাব্য সশস্ত্র আঘাত মোকাবিলায় উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার। অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে এ ভাষণে। যার ফলে বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম স্নায়ুযুদ্ধ-পীড়িত বিশ্বে কোনো এক পক্ষের সংগ্রাম না হয়ে অর্জন করে সার্বজননীন সমর্থন পায়। ফলে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল সোচ্চার, আর এর প্রভাব পড়েছিল অনেক দেশের সরকারের ওপর।

তিনি বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বাঙালিদের একান্ত ও নিজস্ব উচ্চারণ ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। একেবারে আড়ম্বড়হীন, ও বাহুল্যতা ছাড়া লাখো জনতার সামনে এমন অন্তরঙ্গ, প্রায় ব্যক্তিগত সম্বোধন বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিলো। ভাষণের শুরুতেই তিনি বাঙালি আবেগকে উসকে দিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, “আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।” …“আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।”…তিনি যেন বুকভরা ভালোবাসা ও বেদনা নিয়ে তিনি বলেছেন, “৭ জুনে আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।” “আমার পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব, দুঃখী, আর্ত মানুষের মধ্যে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।” “কার সাথে বসব, যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?” “গরীরেব যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে।” “আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়,” । মানুষকে হত্যার প্রসঙ্গ এবং সেই কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব ঘটনাকে চিহ্নিত করছেন আমার লোক, আমার মানুষকে হত্যা হিসেবে,এভাবে বারংবার তিনি উচ্চারণ করেছেন আমার মানুষ, আমার দেশের গরিব-দুঃখি, আমার লোক বলে যা মানুষের মনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আগেবে উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তিনি তাঁর সেই ঔতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানের তেইশ বছরের নিপীড়নমূলক শাসন এবং তার বিরুদ্ধে জনসংগ্রামের ইতিহাসের নির্যাস একটি বাক্যে তুলে ধরতে ও ভূলে যাননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের বুকের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।”

এ প্রসংগে লেখক আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুকে বলতেন বাংলার ভীম, মধ্যযুগের বাংলার লোকায়ত যে নেতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন রাজ্যপাট, নির্মাণ করেছিলেন মাটির দুর্গ, ভিতরগড়ে যে দুর্গ প্রাচীর এখনও দেখতে পাওয়া যায়, মাটির হলেও পাথরের মতো শক্ত। বাংলার ইতিহাসের এমন অনন্য নির্মাণ-কীর্তির তুলনীয় আর কিছু যদি আমাদের খুঁজতে হয়, তবে বলতে হবে ৭ মার্চের ভাষণের কথা। যেমন ছিল মধ্যযুগের বাংলার রাজা ভীমের গড়া পাথরের মতো শক্ত মাটির দুর্গ, তেমনি রয়েছে বিশ শতকের বাংলার লোকনেতা মুজিবের ভাষণ, যেন-বা মাটি দিয়ে গড়া, তবে পাথরের মতো শক্ত ’।
তিনি তাঁর ভাষণে বাঙালিকে একান্ত আপন তুমি সন্মোধণ করে বললেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ তাঁর এ উচ্চারণে প্রতিটি বাঙালির শিরায় শিরায় আবেগ ও উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায়। আর বক্তৃতা শেষ করলেন বাঙালির সংগ্রামের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,_এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ প্রাজ্ঞ ও কৌশলী ভাষণ তাই পৃথিবীর অনেক রাষ্টবিজ্ঞানী আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে প্রদত্ত ভাষণের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে তুলনা করে বলেছেন, আব্রাহাম লিংকনের প্রদত্ত ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পি ও লিখিত ভাষণ, প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক এবং অলিখিত। সে হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটিকেও ছাপিয়ে গেছে। তাই এই ভাষণটি যুগোত্তীর্ণ। যুগে যুগে এ ভাষণ নিপীড়ত, লাঞ্ছিত স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণা ও উদ্দীপনা হিসাবে কাজ করবে। এই কারণেই বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণটি সারা বিশ্বের সমসাময়িক রাজনৈতিক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব রাজনীতির ছাত্র ও রাজনৈতিক গবেষকদের দ্বারা প্রশংসিত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ক্ষমতাবান সরকারসমূহ ও বিশ্ব-সমপ্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। সকল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধিরা ঢাকায় উপস্থিত থেকে ভাষণের বিবরণ প্রদান করেছেন। ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস্’ হিসেবে, সে-কথা আমরা জানি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়; বিশ্ব নেত্রীবৃন্দ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও এ ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ধরণের কিছু বক্তব্য ও বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে মনে করছি। প্রথমেই উদ্ধৃত করছি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মতামত ও বিশ্লেষণ। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন,‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন,‘তিনি ছিলেন মানব জাতির পদ প্রদর্শক।…তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’ পশ্চিম বঙ্গের প্রয়াত সিপিএম নেতা ও সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।’ কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন,‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ মার্শাল টিটো বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানীদের কোন রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’ দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল।’ গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন,‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

একই সাথে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চেও ভাষণের অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। নিউজ উইক,‘পত্রিকার নিবন্ধ দ্যা পয়েট অব পলিটিক্সে বলা হয়েছে,‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে,‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষরেণর মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঐ ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।’ বিবিসি-১৯৭১ ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিস বার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্ল¬বী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ থমসন রয়টার্স ১৯৭১-বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সংগে বিপ্ল¬বের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনা ও দেয়া হয়েছে।’ একই সালে এএফপি বলেছে,‘ ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ ১৯৭১ সালে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়,‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ ‘১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়,‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’ আর বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় বলেছেন,‘কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠবাণী? গণসূর্যে মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর- কবিতাখানী।’

আজকালের পাঠকরা সংক্ষিপ্ত পড়তে চায়। সেই কারণে লেখার পরিধি আর না বাড়িয়ে এই বলেই শেষ করবো আগামী দিনের ঐতিহাসিকরা যখন ইতিহাস লিখবেন সেই ইতিহাসে আপন গৌরব ও মহিমায় মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অনন্য ভাষণ। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে।