সুফিবাদের উৎপত্তি
প্রশ্নঃসূফিবাদ কি? সুফিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা কর। সূফিবাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা কর।
আল্লাহের নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন হল ইসলাম।আল্লাহতা’য়ালা মানব জীবনের সকল কর্মকাণ্ড সমূহ সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)এর মাধ্যমে এ জীবন বিধান পেশ করেছেন।ইসলাম ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত,পারিবারিক,সামাজিক,রাষ্ট্রীয়,ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রভৃতি বিষয় ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে।মানব জীবনের প্রতিটি প্রতিদিকে দুটি স্তর রয়েছে যার একটি হল বাহ্যিক(বস্তুগত) দিক আরেকটি হল আভ্যন্তরীন (আধ্যাত্মিক) দিক।ইসলাম মানুষের দুটি দিক নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে।মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত এ শুধু তার দেহের জন্য করে নাই বরং তার একটি বাতিনী দিক আছে যা হল আত্মা।আত্মার শান্তির জন্য মানবতা যুগে যুগে জড়বাদ,বস্তুবাদের আবর্তে ঘুরছে।কিন্তু প্রকৃত শান্তি তারা খুজে পায় নাই।তাই কবি শেখ সাদী (র.)বলেন,
“এই সমুদ্রে হাজার কিশতী ডুবে গেছে;কিন্তু একটিও ভেসে উঠে নদীর তীরে পৌছে নাই”।
জড়বাদ মানুষের যে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে তা বুদ্বিবাদ তা পূর্ণ করতে পারে নাই আর তার শূন্যতা পূরণ করেছে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা।আর ইসলামের এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের নাম হল সূফীবাদ।মানুষের জীবন আত্মা এবং দেহের সমন্বয় গঠিত।যে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যায় তাই হল তাসাউফ। সূফি শব্দের উৎপত্তি
সূফি শব্দটি কোন শব্দ হতে এসেছে সে ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতদের ভিতর বেশ কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়।সেগুলো নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলঃ
তবে শেষোক্ত মতামত একেবারে অগ্রহণযোগ্য।কারণ বিদেশি কোন শব্দ হতে ইসলামের কোন একটি বিষয় নির্গত হবে তা হতে পারে না। অন্যদিকে প্রথম তিনটি মতামতের ভিত্তিতে যে সূফী শব্দটি এসেছে তাও অনেকে মানতে নারাজ। এ ব্যাপারে মুহাম্মদ আব্দুল মালেক ও মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ স্যারের “ইসলামে সূফী দর্শন” নামক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে,
সূফী কথাটি যে সুফূন(পশম) হতে নির্গত তা গ্রহণযোগ্য নয়।কারণ এর দ্বারা সূফীদের কেবল পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অবয়বের কথা বলা হয়েছে।যেহেতু সূফিবাদ মানুষের বাতিনী দিকের পরিচায়ক তাই এই বাহ্যিক দিকের নির্দেশক পশম হতে সূফীর উৎপত্তি হয়েছে তা যুক্তিসঙ্গত নয়।আবার সাফা(পবিত্রতা) হতে যে সূফী কথাটি এসেছে তাও গ্রহণযোগ্য নয়।কারণ এটা হল সূফীদের জীবন-সাধনার একটি নির্দেশক মাত্র।আবার সফফুন হতে সূফী এসেছে এ কথাও বিশ্বাস করা যায় না কারণ তা একটি কাল্পনিক ধারনামাত্র। একমাত্র আহলে সূফফা(বারান্দার অধিবাসী) শব্দে সূফী তত্ত্বের ও সূফী জীবনের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন দিক পরিস্ফূট হয়ে উঠে।তারাই পশমী পোশাক সর্বদা পরিধান করতেন এবং সর্বদা আল্লাহের যিকিরে মশগুল থাকতেন।তারা আল্লাহের সম্মানে চাদরাবৃত।তারাই নবী করিম (সাঃ) এর সাহচর্যে থেকে সর্বদা আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কাজেই আহলে সুফফা হতে যে সূফী কথাটির উদ্ভব ঘটেছে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। (সূত্রঃ ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতাঃ১০৩)
ইমাম শামী (র.) বলেন, “সূফীবাদ হল আধ্যত্মিক জ্ঞান যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সৎ গুণাবলীর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসৎ গুণাবলীর প্রকারভেদ ও তা থেকে রক্ষার উপায় জানা যায়।”
জুনায়েদ বাগদাদী(রঃ) বলেছেন, “আত্মিক পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহ ছাড়া সবকিছু হতে প্রভাবমুক্ত হওয়ার নাম হল ”
যুন্নন মিসরীর মতে, “আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু আছে সবকিছু বর্জন করার নাম হল সূফীবাদ।”
ইমাম গাযযালী(র.)বলেন, “তাসাউফ এমন একটি বিদ্যা যা মানুষকে পশু হতে উন্নীত করে,মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত প্ররযায়ে পৌছিয়ে দেয়।” তিনি আরো বলেন, “সূফীবাদ হল মু’মিনদের অন্তরের জ্যোতি যা নবী করীম (সাঃ) এর প্রদীপ হতে গ্রহণ করা হয়েছে।”
বায়জীদ বোস্তামী (র.) বলেন, “আল্লাহের ইবাদতে মগ্ন থাকা ও আল্লাহকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে পার্থিব দুঃখ-কষ্ট বরণ করার নাম হল সূফীবাদ।”
শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া (র.) বলেন, “তাসাউফ মানুষের আত্মার বিশোধনের শিক্ষা দান করে।তার নৈতিক জীবনেকে উন্নীত করে এবং স্থায়ী নিয়ামতের আধিকারী করার উদ্দেশ্যে মানুষের ভেতরের ও বাইরের জীবনকে গড়ে তুলে। এর বিষয়বস্তু হল আত্মার পবিত্রতা ও লক্ষ্য হল চিরন্তন সুখ শান্তি অর্জন।”
আবূ মুহাম্মদ আয-যারিনি বলেছেন, “Sufism is the building up of good habits and freeing of heart from all evil desires.” তাহলে বলা যায় যে, নবী করিম (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে আত্মশুদ্বি করে ইসলামের বাহ্য ও অন্তর জীবনের প্রেমপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে পরম সত্তার পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও তার নৈকট্য লাভজনিত রহস্যময় উপলব্ধিকে সূফীবাদ বলা হয়।
১. বেদান্ত ও বৌদ্ব দর্শনের প্রভাব
২. খ্রিষ্টনিয় ও নিও-প্লেটানিক প্রভাব
৩.পারসিক প্রভাব
৪.কুরআন হাদীসের প্রভাব
উপরের তিনটি মতবাদকে আভ্যন্তরীন মতবাদ বলা হয় আর শেষেরটিকে বাহ্যিক উৎস বলা হয়।এসকল মতবাদ নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলঃ
“তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।”[বাকারাঃ২৫৫]
“তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাক”[হাদীদঃ৪]
“তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।” [হাদীদঃ৩]
“আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” [ক্বাফঃ১৬]
“সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো”। [বাকারাঃ১৫২]
“যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব।” [আ্নকাবূতঃ৬৯]
“তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করবে,” [বাইয়েনাহঃ৫]
হাদীসের দ্বারা তাসাইফের কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।একবার রাসূলে করীম (সাঃ)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ইহসান কি? তিনি উত্তরে বলেছিলেন,“ইহসান হল এ বিষয় যে,তুমি যখন নামায পড়বে তখন তুমি এ মনে করবে যে আল্লাহকে তুমি দেখছ আর তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে এই মনে করবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন”।
হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি নিজেকে চিনল,সে আল্লাহকে চিনল”। হাদীসে কুদসীতে আরও এসেছে যে, আল্লাহ বলেন, “যখন আমি আমার কোন বান্দাকে ভালবাসি তখন আমি তার ধ্যান-অনুধ্যানে ও কাজে কর্মে নিকটবর্তী হই। আমি তার চোখ হই যা দিয়ে সে দেখে,আমি তার কান হই যা দিয়ে সে শুনতে পায়,আমি তার হাত হই যার সাহায্যে বিভিন্ন জিনিস ধরে।”
অর্থাৎ,কুরআনে অসঅংখ্য আয়াত ও হাদীসের দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে সূফিবাদ কুরআন-হাদীস হতে নিঃস্বরিত এক ধরনের বাতিনী জ্ঞান।এ ছাড়াও আমরা এ বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখতে পাই যে, নবী করিম (সাঃ) হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত থাকতেন যার দ্বারা বুঝা যায় যে তিনি আধ্যাত্মিক জীবন সাধনায় প্রায় সময় ব্যস্ত থাকতেন। নবী করীম (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আহলে সুফফার কিছু লোক আল্লাহ পাকের ধ্যান সাধনায় এমন সময় ব্যয় করেছেন যার দ্বারা ধারনা করা হয় যে সূফিবাদ কথাটির উৎপত্তি ঘটেছে। অতঃপর খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় হযরত আবূ বকর(রাঃ),উমার(রাঃ),উসমান(রাঃ) ও আলী(রাঃ) প্রত্যেকে তারা শাসনকার্য পরিচালনার পাশাপাশি অসংখ্য ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যস্ত থাকতেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “ আলী(রাঃ) এর মৃত্যুর সাথে খিলাফত ধংসব হতে থাকে আর দামেস্কে যে বর্বরোচিত অত্যাচার শুরু হতে থাকে সেখান থেকে কিছু মানুষ একান্তে ইবাদত বন্দেগী করতে বাধ্য আর সেখান থেকে অতীন্দ্রয়বাদ স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হতে থাকে”।
কুরআন ও হাদীসে সূফিবাদকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে।তা হল ইলমে বাতিনী,ইলমে লাদুন্নী,ইলমে ইলমে তরীকত,ইলমে মারিফত ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। সে সময় হতে হাসান বসরীসহ প্রমুখ তাবিয়ীর মাধ্যমে মরমীবাদ প্রকাশ হতে থাকে।উমাইয়্যা খিলাফত আমলে মানুষের বাহ্যিক চিন্তা-চেতনার এতটা বিকাশ ঘটে নাই যতটা বিকাশ ঘটেছিল আব্বাসীয়দের আমলে।সে সময় সূফিবাদের একটি চূড়ান্তরুপ লাভ করে।সে অর্থাত,হিজরীর ২য় শতকে এসে সূফিবাদ নামে একটি স্বতন্ত্র ইসলামী মরমীধারার উদ্ভব ঘটে।সে সময় যেসমস্ত কারনে সূফিবাদের উদ্ভব ঘটে তার প্রধান প্রধান কারনসমূহ নিম্নরুপঃ
(১)খলিফা হারুন-উর-রশিদের ইন্তেকালের পর তার দুই পুত্র আমীন ও মামুনের ভিতর যখন মতবিরোধ দেখা দেয় তখন এক বীভীষীকাময় রাজনোইতিক অবস্থা বিরাজমান ছিল।অন্যদিকে ইসমাইলীয়া,বাতিনিয়া ও কারামাতিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অনুসারীগণ ধর্মের নামে অভীষ্ট রাজনীতির প্রচারণা চালাতে থাকে।এমতাবস্থায় কিছু লোকজন রাজনীতি থেকে কিছু মানুষ ইবাদতে ধ্যান-মগ্নে থাকার প্র্যাস পান এববগ এর ভিতর শান্তি তারা খুজে পেয়েছিল।
(২)আব্বাসীয়দের খিলাফতামালে মুতাযিলা সম্প্রদায়ের চিন্তা-চেতনার আবির্ভাব ঘটেছিল সেখানে মানুষের ভিতর এক ধরনের সংশায়াত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল আর মুতাযিলাদের সাথে অন্যান্য গোষ্ঠির ভিতর যে দ্বন্দ্বের আবির্ভাব হয়েছিল তা থেকে পরিত্রানের জন্য কিছু লোক আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে শান্তি খুজে পাওয়ার প্রয়াস খুজে পেয়েছিল।
(৩)হানাফী,শাফিয়ী,মালিকি ও হাম্বলী মাযহাব যে আবেগ বর্জিত পরহেজগারিতা নিয়ে এসেছিল সে অবস্থায় সম্পূর্ণ আবেগধর্মী অবস্থার দিকে এক দল মানুষ ধাবিত হচ্ছিল। তাহলে আমরা বলতে পারি যে,তাসাইফের উৎপত্তি প্রকৃতপক্ষে বাহিরের কোন চিন্তা-ধারনা থেকে নয় বরং কুরআন-হাদীস ও মুসলমানদের নিজস্ব চিন্তা-ধারাকে কেন্দ্র করে হয়েছে।মহানবী(সাঃ) এর জীবদ্দশায় এর উৎপত্তি ঘটেছিল যা
প্রকৃতপক্ষে সূফিবাদের আবির্ভাব মুহাম্মদ(সাঃ) এর সময় হতে শুরু হয়।অতঃপর যাকে সর্বপ্রথম মুসলিম সূফী হিসেবে চিহ্নতি করা হয় সে হল হযরত হাসান বিসরি(র.) তার জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে সূফী-সাধকগণ সূফিবাদের ক্রমবিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।তার ভিতর মরমী ও দার্শনিক চিন্তা-ধারার এক অপূর্ব মিলন ঘটেছিল।এছাড়াও সর্বপ্রথম সূফী হিসেবে যার নাম স্বীকৃতি দেওয়া হয় সে হল আবয় হাশিম কূফী।কেউ কেউ আবার জাবির বিন হাইয়্যানকে প্রথম সূফী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।এরপর হিজরীর ২য় শতকে এসে সূফিবাদের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্বি পেতে থাকে।এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সূফীগণ হলেন ইব্রাহীম বিন আদহাম,রাবিয়া বসরী,দাউদ আত-তায়ী ও ফুযায়ল বিন হাইয়ায প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।তাদের কার্যকলাপ ও বাণী থেকে আস্তে আস্তে কৃচ্ছতা জীবনে উদ্ভব ঘটতে থাকে। এরপরে সূফিবাদের ক্রমবিকাশে যুন্নুন মিসরীর ভূমিকা ছিল ব্যাপক।তিনি ইসলামী মরমীবাদকে স্তভ হিসেবে স্থাপিত করেছিল।তাই তাকে সূফিবাদের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।তিনি হাল ও মাকাম সম্পর্কে সূফী-সংক্রান্ত সূত্র প্রদান করেন।অতঃপর যুনায়েদ বাগদাদী যুন্নুন মিসরীর ধারনাকে আরো উন্নতি ও সুসংবদ্ব করেন।
কালক্রমে সূফিবাদের ভিতর সর্বেশ্ববাদের ধ্যান-ধারনা যুক্ত হতে থাকে।এ ধরনের মতাবাদের মূল প্রবক্তা ছিলেন বায়জীদ বোস্তামী ও মানসুর হাল্লাজ।তবে মানসুর হাল্লাজের বক্তব্য কিছুটা বিতর্কিত ছিল যে জন্য তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।অতঃপ্অর ইমামা আল গাযযালী এর সময় থেকে গোড়া সুন্নিবাদী মতবাদ সূফিবাদের ভিতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।তিনি গোড়া ইসলাম ও সূফিবাদের ভিতর একটি সুন্দর মিল তৈরী করেন।।তার সময় অনেল সূফীর আগমন হয় যার মধ্যে আব্দুল কাদির জিলানী,ফরিদ উদ্দিন আত্তার,আল-কুশাউরী,শিহাবুদ্দিন সোহয়ার্দীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সপ্তম হিজরীতে স্পেনে ইবনুল আরাবী সূফিবাদের ক্রমবিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।তিনি সর্বেশ্বরবাদের প্রচলন করেন।তার তার প্রতিষ্ঠিত মতবাদের নাম ছিল “ওয়াহাদুল অজুদ”।তার এই মরমী ধারার ক্রমবিকাশে সাহায্য করেছিলেন জালালুদ্দিন রুমি (র.)।তার মসনবী শরীফ পৃথিবীর ইতিহাস এক অমূল্য গ্রন্থ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছে।ইবনুল আরাবীর এই মতবাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে রুকুনুদ্দিন আলাউদ্দৌলা একটি পৃথক মতবাদ গঠন করেন যা শুহুদিয়া নামে পরিচিত।তার এই সম্প্রদায়কে বাহাউদ্দীন বিশেষভাবে সমর্থন দিয়েছেন এবং হিজরী একাদশ শতাব্দীতে এ মতবাদটি ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে রাখে। পরবর্তীতে সূফী-সাধকদের ভিতর কাশানী,আলজিলি এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।অতঃপর ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক সূফীর আবির্ভাব ঘটে যাদের ভিতর খাজা মইনুদ্দিন চিশতী,বাহাউদ্দিন,শিহাবুদ্দিন,মুজ্জাদিদ আলফে সানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।বিশেষ করে আলফে সানী সূফিবাদকে ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন করে উজ্জীবিত করেন।তিনি প্রকৃতপক্ষে এ শুহুদিয়া সম্প্রদায়কে বিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।অতঃপর ১৮৩৭ সালে মুহাম্মদ বিন আলী ১৮৩৭ সালে আলজেরিয়াতে একটি পৃথক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে সূফিবাদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় ক্রমবিকাশ হতে থাকে।
ক) শরীয়তঃ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় বিধানকে শরীয়ত বলা হয়। সর্বপ্রথম শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হয়। শরীয়তের যাবতীয় বিধানের মধ্য দিয়ে সুফী তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অনুগত করেন। শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ সুফী হতে পারবে না। সুফীরা এ কথাটি জোর দিয়ে বললেও তাদের আচার-আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ অনেক সুফীকেই দেখা যায় তারা মারেফতের দোহাই দিয়ে শরীয়তের বিধান মানতে আদৌ প্রস্তুত নন।
খ) তরীকতঃ সুফীদের পরিভাষায় তরীকত হচ্ছে; শরীয়তের যাবতীয় বিধান অনুশীলনের পর তাকে আধ্যাত্মিক গুরুর শরণাপন্ন হতে হবে। এ পর্যায়ে তাকে বিনা প্রশ্নে গুরুর আনুগত্য করতে হবে।
গ) মারেফতঃ সুফীদের পরিভাষায় মারেফত হচ্ছে, এমন এক স্তর যার মধ্যে বান্দাহ উপনীত হলে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এ স্তরে পৌঁছতে পারলে তার অন্তর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তখন তিনি সকল বস্তুর আসল তত্ত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেন। মানব জীবন ও সৃষ্টি জীবনের গুপ্ত রহস্য তার নিকট সপষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।
ঘ) হাকিকতঃ সুফীদের ধারণায় তাদের কেউ এ স্তরে পৌঁছতে পারলে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রেমের স্বাদ ও পরমাত্মার সাথে তার যোগাযোগ হয়। এটা হচ্ছে সুফী সাধনার চুড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফী ধ্যানের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব আল্লাহর নিকট বিলীন করে দেন। উপরোক্ত নিয়মে ভক্তদের নামকরণ করা ও স্তরভেদ করা একটি বানোয়াট পদ্ধতি। ইসলামের প্রথম যুগে এগুলোর কোন অস্থিত্ব ছিল না। পরবর্তীতে সুফীরা এগুলো নিজের খেয়াল খুশী মত তৈরী করেছে।