লেখক: মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম: ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ সাল জন্মস্থান: সাগরদাঁড়ি গ্রাম, যশোর জেলা পিতা: রাজনারায়ণ দত্ত মাতা: জাহ্নবী দেবী *১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ – কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি *১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দ – হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ। এবং হিন্দু কলেজ ছেড়ে দিয়ে শিবপুরের বিশপস কলেজে ভর্তি হন অবদান: অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন, বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটের প্রবর্তন উল্লেখযোগ্য রচনা: কৃষ্ণকুমারী (নাটক), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (প্রহসন), মেঘনাদবধ কাব্য (কাব্যগ্রন্থ) মৃত্যু: ২৯ জুন, ১৮৭৩ সাল
“এতক্ষণে”– অরিন্দম কহিলা বিষাদে,
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী!
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ! শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;-
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসের! শাস্তি নরাধমে।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পন করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,- ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; – কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,- এ সকলে দিলা
অম্বরে:= আকাশে ,মন্দ্রে:= শব্দে বা ধ্বনিতে
জীমূতেন্দ্র:= মেঘের ডাক
কোপি:= গর্জে ওঠে
বীরেন্দ্র বলী:= বীর বলজন
রাক্ষসরাজানুজ:=রাক্ষস রাজার অনুজ বা রাক্ষসের ছোটভাই
জ্ঞাতিত্ব:= মানবসম্পর্ক , জলাঞ্জলি:= বিসর্জন দেয়া)
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজনে, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।”
মূলভাব:
আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা মানুষ মানবতার জয় গান গেয়েছেন। পুরানো বিভীষণ চরিত্রের বিশ্বাসঘাতকতার স্বরুপ উন্মোচন পূর্বক মেঘনাদের মাধ্যমে কবির স্বদেশের প্রতি গভীর প্রেম,ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ-ই হলো ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’ কাব্যাংশের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
মূলভাব :
বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে রাবণের ছেলে মেঘনাদ এর সাথে তার চাচা বিভীষণের কথোপকথন হচ্ছে। রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধে বিভীষণ স্বপক্ষ ত্যাগ করে এবং রামের দলে যোগ দেয়। যুদ্ধের আগে মেঘনাদ যখন তার জজ্ঞাগারে যায় প্রার্থনা করতে, তখন বিভীষণের সাহায্যে সেখানে লক্ষ্মণও প্রবেশ করে এবং নিরস্ত্র মেঘনাদকে যুদ্ধের জন্য আহবান করে। মেঘনাদ তখন দেখতে পায় দরজায় তারি চাচা বিভীষণ দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে সব ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে এবং তার চাচাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলে। তখন তাদের মাঝে যে কথোপকথন হয়।
mozahid
10/7/2018,thuesday