প্রশ্ন: ‘মুক্তিযুদ্ধের একদিন’
একজন মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি বর্ণনা করো।
উত্তর:
দিনলিপি লেখার অভ্যাসটা ভুলেই
গিয়েছিলাম! আজ এত দিন পর কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। বোধ হয় হাসপাতালে থাকার কারণেই অবকাশটা
পেয়েছি। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। কেননা, অনুভূতির ইতিহাসটা
এত তীক্ষ যে শুধু কয়েকটি শব্দবন্ধের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় না।
গতকাল সকাল থেকেই ঝিরঝির করে
বৃষ্টি পড়ছিল। মিলিটারিরা ক্ষান্ত দিয়েছিল যুদ্ধে। আমরা ম্যাপ নিয়ে বসে ঠিক করছিলাম
কোন ঘাঁটিগুলো দুর্বল, কোন জায়গা থেকে আক্রমণ করলে জয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত। এসব আলোচনা
করতে করতে রাত হয়ে এল। গফুর মাঝির বাড়ি থেকে খাবার এল রাতে। ভাত, ছোট মাছ, ডাল, লালশাক।
যুদ্ধের সময় এ যেন অমৃত লাগে! গফুর ভাই আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। গোপন কিছু তথ্য
দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছে মিলিটারিদের বাংকার উড়িয়ে দিতে। কালকের অপারেশন কীভাবে শুরু
করব, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখ বোজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উত্তেজনায় আমাদের কারোরই
ঘুম আসছিল না।
সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকলে কালকেই
একটা বড় অংশ উড়িয়ে দেব ওদের ক্যাম্পের। কিন্তু সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাত্ করে
গুলির শব্দে সজাগ হয়ে উঠলাম সবাই। হাতে বন্দুক নিয়ে তৈরি হলাম। অতর্কিতে আক্রমণ করে
বসল পাকিস্তানি হানাদারেরা। অবিরাম গুলিবর্ষণ হতে লাগল। আমরা পাল্টা আঘাত করলাম। কিন্তু
তৈরি হয়ে ছিলাম না বলে পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ করতে পারলাম না। যে যার অবস্থানে থেকে
মরণপণ যুদ্ধ করতে লাগল। চোখের সামনে সাথিদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলাম। অস্ত্রের
গগনবিদারী গর্জন এবং আগুনের লেলিহান শিখায় চারদিক কম্পিত হতে লাগল। আমাদের এক সহযোদ্ধা
আমিন গ্রেনেড চার্জ করল। উড়ে গেল মিলিটারিদের বাংকারের অর্ধেক অংশ। আমি ক্রলিং করে
সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। হঠাত্ করে ক্যাম্পের পূর্ব পাশে বিপুল শব্দে বোমা বিস্ফোরণ
হলো। উড়ে গেল পূর্ব পাশটা। পাকিস্তানিরা পিছু হটল ঠিকই। কিন্তু ক্ষতবিক্ষত হলো আমাদের
অনেক তরুণ প্রাণ। বোমার পাঁচটি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলো আমার দুই পায়ে ও ঊরুতে। ব্যর্থ
চেষ্টা করলাম রক্ত আটকানোর। নিজের শরীরটা টেনে সরিয়ে নিলাম খালপাড়ে। ফজরের আজান শুনতে
শুনতে অচেতন হয়ে গেলাম। তারপর আর কী হলো, কিছুই জানি না।
এখন শুয়ে আছি হাসপাতালে। ডাক্তার
স্প্লিন্টারগুলো বের করে দিয়েছেন। আর আমি আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছি। মায়ের
কথা মনে পড়ছে খুব। কিন্তু পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর। এক মাকে পাওয়ার জন্য আরেক মাকে ত্যাগ
করতে হয়। ছোট বোনটাকে কথা দিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে একসঙ্গে পতাকা বানাব।
কখনোই ভাবতে পারিনি, যে কিশোর
ছেলের বয়স হাতে বই-খাতা আর ফুটবল নিয়ে ঘোরার, সে আজ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে। কখনো চিন্তা
করিনি সবুজ ফসলের মাঠ শহিদদের গণকবরে পরিণত হবে। কখনো মাথায় আসেনি প্রবহমান নদী লাশের
স্তূপে থমকে দাঁড়াবে আর নীল পানি রক্তের সাগরে নিমজ্জিত হবে। কী স্পর্ধা ওদের! আমার
দেশের মাটিতে পা দিয়ে আমার দেশের মানুষের বুকে গুলি চালায়? জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয়
আমাদের সম্পদ?
এই দুঃসাহসের পতন আছে। জয় আমাদের
অবশ্যম্ভাবী। কেননা, শহিদের বুকের ওপর ভর করেই একদিন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হবে।
অভ্যুত্থান হবে বাংলাদেশের। ঘরে ঘরে লাল-সবুজ বিজয় নিশান উড়বে। সেদিনের প্রতীক্ষায়
প্রহর গুনছি।