য ফলা র


-ফলা বনাম -ফলা আকার দেয়া বানান
আমাদের এখন উচিত, বানানের এলেবেলে বিশয়গুলো মিটিয়ে ফেলা। বাঙলা ভাষার সারল্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। একুশের মাস এলে কতো বিলাপ শোনা যায়। দুখিনি বাঙলা ভাশা বলে কতো লেখা প্রকাশিত হয়। অবাক হই আমি। বাঙলাকে তো আমরাই দুঃখ দিচ্ছি তাকে বাঙলামন্ত না করে। আর ফোঁটা কাটা অনুস্বারবাদিদের অনুসারিরা আমোদ পাচ্ছে।
. বেগম জাহান আরা
প্রমিত বাঙলা বানান নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। এই ভাশাটা সাধু ভাষা থেকে আলাদা রুপের এবং মুখের ভাষা থেকেও আলাদা রুপের। কথা বলার সময় আমরা যে ভাবে উচ্চারন করি, লেখার সময় তাকেই সাজিয়ে প্রকাশ করতে চেশটা করি লিপিতে। ফলে বানান নিয়ে ভাবতেই হয়েছে সেকালে, এবং ভাবতে হচ্ছে একালেও। মানুশের সাজগোজের ব্যাপারে সৌন্দর্যের যে চেতনাটা মনের ভেতর কাজ করে, যে খুঁতখুঁতানি আরো ভালো সাজের জন্য আকুল হয়, সেই রকম এক প্রকার চেতনা কাজ করে প্রমিত ভাশা বানান রিতি নিয়ে। বানানকে আরও উচ্চারনানুগ এবং আরও লাগসই লিপিতে কি ভাবে প্রকাশ করা যায়, সেটা থাকে চেতনার ভেতরে। তবে উচ্চারনানুগ বানানের প্রতি আমাদের প্রবল ঝোঁক এখন। এই আলোচনায় কিছু দ্রিশটান্ত তুলে ধরতে চেশটা করবো।
প্রমিত বাঙলায় অনেক শব্দের আদি বর্নে শুধু -ফলা দিয়ে লেখা হলেও তার উচ্চারন হয় '-কারান্ত (+-ফলা আকার) যেমন, ব্যয়, ব্যবহার, ব্যত্যয়, ব্যবস্থা, ন্যস্ত, ত্যক্ত, ইত্যাদি। কোনো শব্দের আদি সর দিত্ব হচ্ছে না -ফলার জন্য। এই শব্দগুলো আমরা উচ্চারন করিঃ ব্যায়, ব্যাবহার, ব্যাত্যয়, ব্যাবস্থা, ন্যাস্ত, ত্যাক্ত, এই ভাবে। মানে, লিপি উচ্চারনকে প্রকাশ করতে পারছে না। অথবা বলা যায়, উচ্চারন অনুযায়ি লিপি হচ্ছে না।

 অন্যদিকে -ফলা আকার দিয়েও বাঙলা শব্দ আছে। যেমন, ব্যাকরন, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, ব্যাধ, ব্যাকুল, ব্যাখ্যা, খ্যাপা, ব্যাঙ, ইত্যাদি। এরকম শব্দগুলোর উচ্চারন আর বানানে ফারাক নেই।
সেজন্য বিভ্রান্তিও নেই পড়তে বা বলতে।
আবার ব্যাতিক্রম, ব্যাতিহার, ব্যাক্তি, ইত্যাদি শব্দের উচ্চারন করি, বেতিক্রম, বেতিহার, বেক্তি। এই বানানও উচ্চারনের প্রতিকুলে।
তাহলে বিশয়টা দাঁড়ালো এইঃ
) শুধু -ফলা দেয়া বর্নের উচ্চারন করছি '-কারান্ত,
) -ফলা আকার দেয়া বর্নেরও উচ্চারন করছি '-কারান্ত,
) -ফলা আকার দেয়া শব্দের উচ্চারন করছি -কারান্ত।
এরকম বানান আর উচ্চারনে বিভ্রান্ত হওয়া খুব সাভাবিক। আমরা হচ্ছিও। সেই কারনে এমন বানান লেখার ক্ষেত্রে প্রজন্ম এলেবেলে করে ফেলে অনেক সময়। একে আমি ভুল বলতে পারি না। কিংবা পারি না তাদের বানান কাটতেও। এমন এলেবেলে বানান আর উচ্চারনের ব্যাকরন হয়তো পাওয়া যাবে(আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো), কিন্তু সেই ব্যাকরন বাঙলাভাশির প্রয়োজন নেই।
-ফলা আকার দেয়া বানানের উচ্চারন যখন -কারান্ত হচ্ছে, তখন যদি শিশু শিক্ষার্থি -দিয়ে সেই বানান লেখে, তাকে ভুল বলার দিন আর নেই। সে বলবে, সে উচ্চারনানুগ বানান লেখছে। আমিও সেই কথা বলতে চাই। 'বেক্তি' লেখার জন্য 'ব্যক্তি' লেখার কোনো যুক্তি নেই আমার বিচারে।। আদিসরের -ফলা এখানে অযথাই দেয়া হয়েছে। তার না আছে দিত্ব, না আছে '-কারত্ব। 'বেক্তি' বলতে পারলে বাঙলা বানানে তা লেখতেও পারা যায়। এখন তো উচ্চারনানুগ বানানের দিকেই আমাদের দ্রিশটি। কারন সেটাই বাঙলা বানান। সহজ বানান।
মুখের ভাষার বানান।
আবার শুধু -ফলা দিয়ে যে সব শব্দের উচ্চারন '-কারান্ত হয়, সেখানে -ফলা আকার দেয়াই সঙ্গত। তাহলে উচ্চারনের সাথে বানানের মৈত্রি থাকে। তাই 'ব্যস্ত, ব্যয়,' না লেখে 'ব্যাস্ত, ব্যায়' লেখার পক্ষে আমি। এখানেও শব্দগুলোর আদি সরে -ফলা থাকার জন্য দিত্ব হচ্ছে না। বেকার একটা '-ফলা' বর্নের পরে বসে আছে। বানান তো ততসম বানান। হয়তো আমাদের মনে হতে পারে -ফলার ভার বহনের জন্য -কারের প্রয়োজন হচ্ছে আমাদের।
এরকম ততসম শব্দগুলোর মুল উচ্চারনে কিন্তু '-কার নেই। সেটা অনুমান করে কিছু ভাশি একদা 'ববহার' বলেছেন। আমি নিজের কানে তা শুনেছি। যেহেতু - দিত্ব হচ্ছে না, আবার '-কারও হচ্ছে না, তাই ববহার করে নিয়েছেন তাঁরা নিজে নিজেই। -এর ওপর একটু জোরও দিয়েছেন। এখনও কিন্তু 'ব্যত্যয়' শব্দের উচ্চারন করতে পারেন না অনেকেই। আমি তো 'ব্যাত্যয়' বলার পক্ষে। বলিও তাই। আদৌ যদি শব্দটা বলি।
এই বিভ্রান্তিমুলক বানান এবং তার উচ্চারনের জন্য কিন্তু বেশি শব্দ নেই বাঙলায়। বাঙলা বানানকে যদি একটা শ্রিংখলায় আনতে হয়, তাহলে এরকম শব্দকে ছাড় দেয়া যায় না। কিংবা 'চালু হয়েই আছে' বলে মেনে নেয়া যায় না। ভাষা একটা শ্রিংখলামন্ডিত বিশয়। শুধু উচ্চারনকে ঘশে মেজে নিলেই চলবে না। একই সাথে বানানেওকেও উচ্চারনের অনুগত করতে হবে। সেটাই শ্রিংখলা। এতে অযথা অভিধান নিয়ে বসতে হবে না। আর তাছাড়া অভিধান তো আমাদের মুখের ভাশাকেই তুলে ধরবে। সে জন্যই দরকার হবে উচ্চারনানুগ বানান।

কেউ কেউ ফরাসি ভাষার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সে ভাশাও তো উচ্চারনানুগ নয়। নাই হলো। তাতে বাঙলার কি আসে যায়? বাঙলা তো ফরাসি ভাষার সাথে সই পাতিয়ে বসে নেই? এক সংস্ক্রিত ভাষার পরাক্রান্ত প্রভাবেই আমরা হাঁসফাঁস করছি। বাঙলা বানান লেখলেই সংস্ক্রিতমন্য মৌলবাদিরা খেপে যায়। আর বুদ্ধিব্রিত্তিক মৌলবাদিরা তাদের সাথে হাত মেলায়। ভাবনা চিন্তা করে দিক নির্দেশনা দেয়া তো দুরের কথা, আইন জারি করেন পুরনো বানান বহাল রাখার জন্য। যেনো ভাশা আর মানুশ আলাদা। মানুশ বদলালে ভাশাও বদলাবে, এটাই তো সাভাবিক।
আর একটু ভেঙে বলি। আমাদের বাপ দাদারা মালকোছা মেরে মাছ ধরলেও আমাদের প্রজন্ম যে হুইল ছিপে বাবু বেশে মাছ ধরতো, এবং এখনকার প্রজন্ম যে বিশয়টাই জানে না, এই পরিবর্তন মেনে নিতে আপত্তি নেই কারো। কিংবা একটা প্লাস্টিকের জুতো পরে গাঁয়ের বহু বর বিয়ে করতে যেতো, একটা পাগড়ি থাকলে সারা গাঁয়ের বর সেটা মাথায় দিয়ে বরের বেশ ধারন করতো, সেটা কি এখন আছে? এই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন কি কম বড়ো পরিবর্তন? আবার হালে কনে সাজানোর যে বিলাসি আয়োজন, বা পার্লারে গিয়ে কনের বাড়ির মেয়েদের সাজু গুজুর যে সৌখিন আয়োজন, সে কথা এক প্রজন্ম আগেও কি ভাবা যেতো? এই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু বাঙলা বানানকে থাকতে হবে সংস্ক্রিতের হিজাবে ঢাকা। কেমন মানসিকতা আমাদের? বানান তো বদলেই গেছে মুখে মুখে।
এমন কি রোমান হরফে প্রজন্ম যখন বাঙলা লেখে, তখন সেখানে হ্রস্ব দির্ঘ বা -এর বালাই থাকে না। থাকে না মুর্ধা বা মুর্ধা -এর কোনো ফারাক। তখন তো আমরা কিছু বলতে পারছি না। মানে মেনে নিচ্ছি বলা যায়। সেই বানান প্রমিত বাঙলায় লেখলে এতো আপত্তি কেনো? বাঙলা শুধু সহজ ভাশা নয়, খুব আধুনিক এবং বিজ্ঞানলগ্ন ভাষা। এর প্রমিত উচ্চারন লিপিতে লেখা যায় অনায়াসে।
আমাদের এখন উচিত, বানানের এলেবেলে বিশয়গুলো মিটিয়ে ফেলা। বাঙলা ভাষার সারল্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। একুশের মাস এলে কতো বিলাপ শোনা যায়। দুখিনি বাঙলা ভাশা বলে কতো লেখা প্রকাশিত হয়। অবাক হই আমি। বাঙলাকে তো আমরাই দুঃখ দিচ্ছি তাকে বাঙলামন্ত না করে। আর ফোঁটা কাটা অনুস্বারবাদিদের অনুসারিরা আমোদ পাচ্ছে।

(বানানরীতি লেখকের নিজস্ব)

. বেগম জাহান আরা: প্রাবন্ধিক, গবেষক কলাম লেখক। সাবেক অধ্যাপক আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়