প্রশ্ন:১ পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগবিধি কী কী?
১. মূল ভাষায় প্রতিশব্দ না থাকলে পরিভাষা প্রয়োগ করা যায়। যেমন: পুলিশ চোরকে ধরতে এসেছে। পুলিশের প্রতিশব্দ নেই।
২. মূল ভাষায় টেকসই প্রতিশব্দ না থাকলে পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। যথা: ছেলেমেয়েরা টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশন শব্দের প্রতিশব্দ দূরদর্শন। তবে এ শব্দটি টেকসই নয়।
৩. মূল ভাষায় প্রতিশব্দটি অপ্রচলিত হলে পরিভাষা প্রয়োগ করা হয়। যথা: টেবিলে কলমটা রাখো। টেবিলের প্রতিশব্দ চৌপায়া, তবে এটি প্রচলিত নয়।
৪. মূল ভাষার প্রতিশব্দটি সর্বসাধারণের বোধগম্য না হলে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। যেমন: গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪হ্ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিগ্রির প্রতিশব্দ মাননির্ণয়ক বিশেষ বলে অভিহিত করা হয়। তাই ডিগ্রি লেখাই শ্রেয়।
৫. পৌনঃপুনিক ব্যবহারের কারণে প্রতিশব্দ থাকলেও পরিভাষা প্রয়োগ করা যায়। যথা: অ্যাকাউনট্যান্ট পদে লোক নিয়োগ করা হবে। Accountant-এর প্রতিশব্দ হিসাবরক্ষক। কিন্তু অ্যাকাউনট্যান্ট বারবার ব্যবহূত হয়।
৬. সহজে গ্রহণযোগ্য পরিভাষা প্রয়োগ করা যায়। যেমন: টেলিফোন নষ্ট হয়ে গেছে। টেলিফোনের প্রতিশব্দ ‘দূরালাপনী’ কিন্তু টেলিফোন সহজে গ্রহণযোগ্য।
৭. অফিস-আদালতে ব্যবহার করা শব্দ পারিভাষিক হওয়াই উত্তম। যেমন: বিল জমা দেওয়া হোক। এখানে বিলের পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
৮. অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মূল ভাষার প্রতিশব্দ সৃষ্টি করে শব্দের সর্বজনীনতা নষ্ট করা উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে পরিভাষা প্রয়োগ করা ভালো। যেমন: স্কুল খোলা নেই। স্কুলের পরিবর্তে বিদ্যালয় প্রয়োগ করলে সর্বজনীনতা নষ্ট হয়।
প্রশ্ন:২ পারিভাষিক শব্দ কাকে বলে? পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজনীয়তা কী?
অথবা, পারিভাষিক শব্দ কী? পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজনীয়তা কী লেখ।
পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা: পরিভাষা ব্যবহারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়তা হয় তখন, যখন প্রচলিত শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ যখন পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও সেটি যদি অপ্রচলিত থাকে, তবে পরিভাষার প্রয়োজন দেখা দেয়। মনে রাখা দরকার, ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। ভাষা প্রবহমান নদীর মতো। পরিভাষা সুনির্দিষ্ট অর্থবহ বলেই তা প্রচলিত হয়েছে। অনেক সময় মূল ভাষার শব্দ টেকসই থাকে না বলেও পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। মনে রাখতে হবে, পরিভাষা, বিকল্প ভাষা ও সহজবোধ্যতার জন্যই ব্যবহূত হয়। যেমন: পুলিশ, ফ্যান-এর প্রতিশব্দ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলেই পরিভাষা ব্যবহার করতে হয়।
প্রশ্ন:৩ পারিভাষিক শব্দ বলতে কী বোঝো? কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের উদাহরণ দাও।
অথবা, পারিভাষিক শব্দ বলতে কী বোঝো? পাঁচটি পারিভাষিক শব্দের উদাহরণ দাও।
অথবা, পরিভাষিক শব্দ কাকে বলে? বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব আরোপ করো।
অথবা, পারিভাষিক শব্দ কাকে বলে? কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের উদাহরণ দাও।
পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব: বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো:
১. বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ওই শব্দগুলোকে বোঝানোর জন্য পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ রয়েছে।
২. জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক শব্দকেই বিশিষ্ট অর্থে বা পারিভাষিক শব্দরূপে গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়।
৩. বাংলা ভাষার মধ্যে অনেক বিদেশি শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর মধ্য থেকে বাংলা শব্দভান্ডারে কিছু শব্দ গৃহীত হয়েছে আবার কিছু বর্জিত হয়েছে। অর্থাৎ পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষার বিকল্প এবং সহজবোধ্যতার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব অনেক।
প্রশ্ন:৪ কী কী উপায়ে বাংলা ভাষার শব্দ গঠন করা যায়? উদাহরণসহ আলোচনা করো।
১. উপসর্গযোগে শব্দ গঠন: এ প্রক্রিয়ায় ধাতু বা শব্দের পূর্বে উপসর্গযুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে। যথা: প্রতি+রোধ = প্রতিরোধ; উপ+শহর = উপশহর ইত্যাদি।
২. প্রত্যয়যোগে শব্দ গঠন: এ ক্ষেত্রে ধাতু বা শব্দের শেষে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে। যেমন: পড়+আ = পড়া পশ্চিম+আ = পশ্চিমা।
৩. সমাসের সাহাযে্য শব্দ গঠন: দুই বা ততোধিক পদ এক পদে পরিণত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে। যথা: বছর বছর = ফি বছর; নীল যে আকাশ = নীলাকাশ।
৪. সন্ধির সাহাযে্য শব্দ গঠন: এই প্রক্রিয়ায় পাশাপাশি দুটি বর্ণের একত্রীকরণ ঘটে এবং নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়। যেমন: হিম+আলয় = হিমালয়; পর+উপকার = পরোপকার।
৫. বিভক্তির সাহাযে্য শব্দ গঠন: এ ক্ষেত্রে কতগুলো বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে একধরনের নতুন শব্দ তৈরি করে। যেমন: কর+এ= করে; রহিম+এর = রহিমের ইত্যাদি।
৬. দ্বিরুক্ত শব্দ বা দ্বিরাবৃত্তির মাধ্যমে: দ্বিরুক্ত শব্দ বা দ্বিরাবৃত্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষায় প্রচুর শব্দ তৈরি হয়। যেমন: ঠনঠন, শনশন, মোটামুটি, তাড়াতাড়ি ইত্যাদি।
৭. বিদেশি শব্দের উচ্চারণ বিকৃতি: বিদেশি শব্দের উচ্চারণ বিকৃতি ঘটেও বাংলা ভাষায় বেশ কিছু শব্দ তৈরি হয়েছে। যেমন: Tubewell« ট্রিপকল, Office«অফিস ইত্যাদি।
৮. অনুবাদের মাধ্যমে: বিদেশি শব্দের অনুবাদের মাধ্যমেও বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ হয়েছে। যেমন: Lions share«সিংহভাগ, Son of soil«ভূমিপুত্র ইত্যাদি।
প্রশ্ন:৫ বাক্য কাকে বলে? একটি সার্থক বাক্যের কী কী গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক?
অথবা,
বাক্য বলতে কী বোঝ? একটি সার্থক বাক্য গঠনে কী কী গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন? উদাহরণসহ আলোচনা করো।
ডক্টর সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘পরস্পর অর্থ সম্বন্ধবিশিষ্ট যে পদগুলোর দ্বারা একটি সম্পূর্ণ ধারণা বা বক্তব্য বা ভাব প্রকাশ পায়, সে পদগুলোর সমষ্টিকে বাক্য বলে।’
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, একটি সম্পূর্ণ মনোভাব যে সমস্ত পদ দ্বারা প্রকাশ করা যায়, তাদের সমষ্টিকে বাক্য বলে।
একটি সার্থক বাক্যের গুণাবলি: ভাষার বিচারে একটি সার্থক বাক্যের নিচে তিনটি গুণ থাকা আবশ্যক।
১। আকাঙ্ক্ষা,
২। আসত্তি এবং
৩। যোগ্যতা।
আকাঙ্ক্ষা: বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা, তা-ই আকাঙ্ক্ষা। যেমন: ‘চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে—’ বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না, আরও কিছু শোনার ইচ্ছা হয়। বাক্যটি এভাবে পূর্ণাঙ্গ করা যায়— ‘চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে’। এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে বলে পূর্ণাঙ্গ বাক্য।
আসত্তি: বাক্যের অর্থসংগতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদ বিন্যাসই আসত্তি। মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পরপর সাজাতে হবে যাতে মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। যেমন: কাল বিতরণী হবে উৎসব কলেজে আমাদের পুরষ্কার অনুষ্ঠিত। এখানে পদগুলোর সঠিকভাবে সন্নিবেশ না হওয়ায় বাক্যের অন্তনির্হিত ভাবটি যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়নি। তাই এটিকে বাক্য বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে পদগুলোকে নিচের যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে। কাল আমাদের কলেজে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এটি একটি আসত্তি সম্পন্ন বাক্য।
যোগ্যতা: বাক্যস্থিত পদগুলোর অন্তর্গত এবং ভাবগত মিলনবন্ধনের যোগ্যতা। যেমন: বর্ষার বৃষ্টিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কারণ, বাক্যটিতে পদগুলোর অর্থগত এবং ভাবগত সমন্বয় রয়েছে। কিন্তু বর্ষার রৌদ্র প্লাবনের সৃষ্টি করে বললে বাক্যটি ভাব প্রকাশের যোগ্যতা হারাবে, কারণ, রৌদ্র প্লাবন সৃষ্টি করে না।
প্রশ্ন:৬ বাক্য কাকে বলে? গঠন অনুসারে বাক্যে কত প্রকার ও কী কী? উদহরণসহ আলোচনা করো।
অথবা, গঠন অনুসারে বাক্য কত প্রকার ও কী কী, আলোচনা করো।
ডক্টর সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘পরস্পর অর্থসম্বন্ধবিশিষ্ট যে পদগুলোর দ্বারা একটি সম্পূর্ণ ধারণা বা বক্তব্য বা ভাব প্রকাশ পায়, সে পদগুলোর সমষ্টিকে বাক্য বলে।’
গঠন অনুসারে বাক্য: গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার। যথা
সরল বাক্য: যে বাক্যে একটি মাত্র কর্তা এবং একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যথা: দ্বীনা বই পড়ে। এখনে দ্বীনা কর্তা এবং পড়ে সমাপিকা ক্রিয়া।
জটিল বাক্য: যে বাক্যে একটি মাত্র প্রধান খণ্ড বাক্য এবং তার ওপর এক বা একাধিক নির্ভরশীল বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহূত হয়, তাকে জটিল বাক্য বলে। যেমন: যে পরিশ্রম করে সেই সুখ লাভ করে। এখানে ‘যে পরিশ্রম করে’ নির্ভরশীল বাক্য এবং ‘ সেই সুখ লাভ করে’ প্রধান খণ্ড বাক্য।
যৌগিক বাক্য: পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা জটিল বাক্য কোনো অব্যয় দ্বারা সংযুক্ত হয়ে একটি পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যেমন: লোকটি ধনী কিন্তু অসুখী। যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্যগুলো এবং ও, কিন্তু, অথবা, অথচ প্রভৃতি অব্যয় যোগে সংযুক্ত থাকে।
প্রশ্ন:৭ অর্থ অনুসারে বাক্য কত প্রকার এবং কী কী? আলোচনা কর।
ক) বর্ণনামূলক বাক্য: যে বাক্য দ্বারা সাধারণভাবে কোন কিছু বর্ণনা বা বিবৃত করা হয়; তাকে বর্ণনামূলক বাক্য বলে। বর্ণনামূলক বাক্যকে বিবৃতিমূলক বাক্য বলে। যেমন- ‘বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ।’ বর্ণনামূলক বাক্যকে আবার স্বীকৃতি-জ্ঞাপক বা অস্তিবাচক এবং অস্বীকৃতি-জ্ঞাপক বা নেতিবাচক এ দুইভাগে ভাগ করা যায়।
অ) অস্তিবাচক : যে বাক্যের বক্তব্য বিষয়ে হ্যাঁ সূচক মনোভাব প্রকাশ পায় তাকে অস্তিবাচক বাক্য বলে। যেমন : রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠকাব্য গীতাঞ্জলি।
আ) নেতিবাচক : যে বাক্যের বক্তব্য বিষয়ে না সূচক মনোভাব প্রকাশ পায় তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে। যেমন : বাবা আজ বাড়ি নেই।
খ) প্রশ্নবাচক বাক্য: যে বাক্য দ্বারা কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় বা জানতে চাওয়া হয় তাকে প্রশ্নবাচক বাক্য বলে। যেমন- তুমি কী পড়ছো? পরীক্ষা কেমন হলো? ইত্যাদি।
গ) আদেশ বা উপদেশমূলক বাক্য : যে বাক্য দ্বারা আদেশ, উপদেশ, অনুগ্রহ প্রভৃতির ভাব প্রকাশ পায়; তাকে আদেশ বা উপদেসমূলক বাক্য বলে। যেমন- আদেশ- এখনই পড়া শেষ করবো। উপদেশ- মিথ্যা বলো না। অনুগ্রহ- দয়া করে কলমটি দিন।
ঘ) প্রার্থনামূলক বাক্য : যে বাক্যে প্রার্থনার ভাব প্রকাশিত হয় তাকে প্রার্থনামূলক বাক্য বলে। যেমন- সুখী হও। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
ঙ) বিস্ময় বা আবেগসূচক বাক্য : যে বাক্য দ্বারা বিস্ময় বা বিভিন্ন প্রকার আবেগ প্রকাশিত হয় তাকে বিস্ময় বা আবেগসূচক বাক্য বলে। যথা- বাহ! কী সুন্দর দৃশ্য।
এছাড়াও আরও দুই প্রকার বাক্য পাওয়া যায়। যেমন : ক) কার্যকারণাত্মক বাক্য : যে বাক্য যদি, যদ্যপি প্রভৃতি অব্যয় যোগে গঠিত এবং যাতে কারণ, নিয়ম, শর্ত, ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ পায় তাকে কার্যকারণাত্মক বাক্য বলে। যেমন : যদি বৃষ্টি হয় তবে ফসল ভালো হবে।