ছাড়পত্র
- সুকান্ত ভট্টাচার্য---ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।
১৯৪১ সাল
- সুকান্ত ভট্টাচার্য---ঘুম নেই
নীল সমুদ্রের ইশারা-
অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ,
আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা;
নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল
মত্ততাময় পদক্ষেপঃ
এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর
জীবনের ওপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয়
তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে
ডাক এল-
সভ্যতার ডাক
নিষ্ঠুর ক্ষুদার্ত পরোয়ানা
আমাকে চিহ্নিত ক'রে গেল।
আমার একক পৃথিবী
ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে।
মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা
গভীরতা রচনা করে,
আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা
ইতস্ততঃ ধাবমান।
নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল
পূর্ণতায় মূর্তি চায়;
আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ,
আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা
তাই পরাহত হল।
কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা
আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক!
দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস।
যে সব মুহূর্ত-পরমাণু
গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা,
সে সব মুহূর্ত আজ
প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায়
অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে।।